সোমবার, ২১ মার্চ, ২০১৬

শাকিলা তুবা



অস্বচ্ছ কাঁচ
শাকিলা তুবা

যে মানুষটিকে ভালবাসে এই শহর
তাকে চক্রবৃদ্ধি হারে ভালবাসা যায়
তার চোখের ভেতর নবরত্নের গহনা
ভালবেসে নিঃস্ব হতে মন চায়।

পলাতক সময়ের কাছে রয়েছে কিছু ঋণ
বোঝার মতো বয়ে বেড়াই বারোমাস
সেই সব যাতনার ঝোলা বেঢপ হয়ে বাড়ে
ক্রমশঃ বাড়ছে সুদের হার।

যে মানুষ কে ভালবাসে এই শহর---
কোন কোন কাকডাকা ভোরে সে চুরিও হয়
আজ যে মানুষ আমার, কাল অন্যের।

হিসাব মেলে না, অংকে বড়ই কাঁচা
সে কার তবে? সরল অংকে ঐকিক নিয়ম?
জীবন থেকে যে হারায়?
তাকে বিয়োগ দিয়েও কেন সে থেকে যায় সর্বত্র?

নেই মানুষটি শুন্য বটে তবু সংখ্যায় সে এক।






আঁকিবুকি
শাকিলা তুবা
এরপর তুমি আঁকলে একটা গাছ, শুধুই গাছ
গাছের ছায়ায় উদাস দুপুর,
আর আঁকলে বাঁশী বাজানো রাখাল
যার পা ছুঁয়ে বয়ে গেছে শীর্ণ ধারার নদী।

আমি বললাম, গাছটা এমন ন্যাড়া কেন?
সবুজ বাড়াও, আরো পাতা জমে যাক
গাছের মাথায় তুমি এঁকে দিলে আঁকাবাঁকা গ্রাম
আর ময়ুরকণ্ঠী রঙের মমতা।

তোমার রঙ-তুলি, তারপিন তেল আর তুলোয়
আঙ্গুল ভেজালাম আমিও
এবার আমি এঁকে দিলাম গাছের উপর পাখীদের ঘরদোর,
দুটো পাখীর বসন্ত বাতাসে দোল খাওয়া।

তুমি বললে, উঁহু এখনো হয়নি
তুমি আঁকলে দুটো পাখির ছানা, পাশে কিছু সম্ভাবনাময় ডিম
আমি বললাম, তাহলে একটা সাপও আঁকো ডালে অথবা
মাথার উপর ছানা লোভী চিল, জীবন যেমন হয় আর কি!

তুমি বললে, গাছটাকে এভাবেই পরিপূর্ণ দেখাচ্ছে তাই না!
আমি বললাম, তাহলে এটা একটা সুখী গাছের ছবি, বলো!






সেলাইঘর
শাকিলা তুবা

পুরো জায়গা জুড়ে কেবল শিশুরাই ছিল
আর ছিল দেব-পুত্রগণ
ওরা ফাঁপা জায়গায় শুয়েছিল
কারো হাত নেই, পা চলে গেছে ভেতরে
তবু সবাই সন্তুষ্ট ছিল
পেটের চিন্তা করতে হচ্ছিল না বলে।

একটা রুটির ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের চেয়েও বেশী
মৃত্যুকুপে বসে ওরা এক থাল ভাতকে অভিশাপ দিচ্ছিল
সেজন্যেই ওরা ক্রমশঃ শিশু হয়ে উঠছিল
বাইরের দর্শনপ্রার্থীরা শুনছিল গোঙানী
যে মেয়েটির সালোয়ার ছিঁড়ে গিয়েছিল
সে ধন্যবাদ জানিয়েছিল উদ্ধারকারীকে।

উদ্ধারকারীরা ছিল দেবতার ছেলে
ওরা তাকিয়ে দেখেনি নারী শরীর
একজন মা অকাল প্রসবের রক্তাল্পতায় চলে গেছে
রেখে যাওয়া শিশুটিও তখন মৃত
নূপুর পরা পা জোড়া নিথর
ভাত বড় সর্বনাশ ডেকে আনে।

মসজিদ, মন্দির আর গির্জায় আলো জ্বলেনি
এত এত শিশুকে ভুলে থাকা যায় না বলে
ঘুমোয়নি ব-দ্বীপের কেউ
একটা নিঃশ্বাসও যদি ভেসে যায় নক্ষত্র হয়ে
ক্ষমা করবে না কেউ কাউকে
নাগরদোলা দুলে দুলে ঘুরছেই শুধু।

সবাই দোষ দিচ্ছিল, কাদা ছুঁড়ছিল নিজেদের দিকে
দেব-পুত্রদের দেখেও কি আলো জ্বলেনি কারো চোখে?
সেলাই কলের শিশুগুলো ফিরে আসুক, এই তো প্রত্যাশা।






অববাহিকা
শাকিলা তুবা

নদীর কথা ভাবতে ভাবতে খুন হয়ে যায়
নিরিবিলি জল---
চুলের চিকন প্রান্তে, যেখানে পোনার ঝাঁক
বালিহাঁসের ভেজা ঠোঁট ডুব দিয়ে আছে
তারই সীমান্ত সকাশে ভাবনার রেশ,
বড়শী আঁটা ছিপ শুধুই উথাল পাথাল।

নদী যায় পরবাসে, ভূমিপুত্রের বর খুঁজে খুঁজে
ঠাঁই নেই কোথাও---নদী চলে যায় আরো নিরালায়
বুনো ফুল ঝরে পড়ে নরম গালে
এঁকে দেয় আপন সৌন্দর্যের চিত্রপট
মোলায়েম পায়ে, ছন্দ-সুরে কেন যে তবু এই বয়ে চলা!
বুকের ভেতর পোকা আর গাছেদের ঘরবাড়ী।

পাথরের ফাঁকে শুকনো শ্যাওলা সবুজ
ঝর্ণা হয়ে ভিজিয়ে দেবার এই প্রয়াস
কেবলই মাটি খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত, হয়রান
নদী বয়ে যায়---ঠাঁই নেই মাটিতে, ঠাঁই নেই পাথরে
মনও তবে সর্পিল এমন, আবাসের খোঁজে ছুটে যাওয়া নদ
ঝরা-ফুল পাপড়ি আর কুঁচো মাছেদের সাথে করে যায় স্নান।






মৃদু জলে রাজহংসী পালক
শাকিলা তুবা

কেন তবে এমন ভোর আসে
পেঁয়াজ খোসার মতো পাতলা আবরনে ঢেকে?
বারবার আজানের পাশাপাশি ভেসে আসে কিছু কথা
কে যেন কবিতায় লিখেছিল, প্রিয়তমা তুমি ধোঁকায় পড়ো না
আকাশে এখনো সুর্যটা ভাসেনি, লালচে আলোয় পৃথিবী শুনশান।

ঋনী করেছিলে তোমার পায়ের শব্দে
তোমার হাসির কাছেও জমেছিল কিছু ঋন
প্রিয়তমা অবশেষে তুমিও ধোঁকায় পড়েছ বিপন্ন যৌবনবোধে
বিষ্ময় শুধু ভোরেই স্পষ্ট হয়নি, টেনে নিয়ে গেছে আসন্ন গোধুলী তক
বুকের ভাঁজে জমানো ঘাম যাকে মধু বলা যায় তুমি অন্যকে দিয়েছ অবশেষে।

অনেক রাত্রি যাপনের পর বুঝেছি
আসলে শৈশবেই কাঁচা কুল চুরি করা যায়
বড় হওয়ার জ্বালা এই যে তোমাকে পরবাস দিলাম ঠিক
তুমি ধোঁকায় পড়ে আমাকে ধোঁকা দিতে চাইলে এটাই মর্মান্তিক
শেষ দৃশ্যে নিজেকে সেই শৈশবে ফিরে পেলাম, আমাকেই ঋনী করে গেলে শেষে!







নাইটকুইন অথবা জংলীলতা
শাকিলা তুবা

একদিন তোমার কাছে যেতে চেয়েছিলাম
যদিও পথ ছিল বন্ধুর
সাঁওতালী মেয়েরা খোঁপার মালা ছুঁড়ে ফেলেছিল জঙ্গুলে পাহাড়ে
সেখান থেকে বাতাস শোঁ শোঁ শব্দে খুলে ফেলেছিল বসন
আমি শুধু নির্নিমেষ চেয়েছিলাম জুম ক্ষেতের শালিকটির দিকে।

তারপর? তারপর আমার কথা ফুরালো, নটে গাছটি মুড়ালো
না, না কথা তো ফুরায়নি---
জলের গন্ধ ভালবাসতাম বলে শাপলা ডাঁটা চিবিয়েছি কতদিন
তোমাকে ভেবেই কার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছি, মনেও পড়েনা
আসলে এই মনটাই হলো নচ্ছাড়
কেমন হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম অন্য আঙ্গিনায়!

চারপাশে ঝরা বকুল আর ডালিম ফুলের মৌ-তাঁতে ডুবে আছি
নিঃশ্বাস নিলেও বুঝি তোমার ঠোঁটের সেই মিঠেকড়া ঘ্রানটুকু পাই
যাওয়া হয়নি রাতের সিনেমায় আর
এখন এখানেই নিত্য ফোটে দুর্লভ সব নাইটকুইন
নাকের পাশে ছোটাছুটি করে অচেনা কোন আফটার শেভের ঝর্ণাধারা।

এই দুপুরটা ক্লান্ত ভারী---একা ঘরে হঠাৎ তোমার ছায়া দেখি
মনে পড়ে, একদিন যেতে চেয়েছিলাম তোমার কাছে
ঐ বুনো ফুল ছড়ানো পথ ধরে যতটুকু যাওয়া যায়
তুমি কবে ছায়া হয়েছ মনে নেই
শুধুই যেন রয়ে গেলে অবসরের এক ক্লান্ত দুপুর হয়ে


অন্য কোনো ছায়া চুপিসারে কখন সশরীর ঢুকে গেছে আমার মজ্জায়।