সোমবার, ২১ মার্চ, ২০১৬

মৌ দাশগুপ্ত




নারদ নারদ
মৌ দাশগুপ্ত
*************
আজকের নরনারায়ণ সময়ে নারদের ঢেঁকি বিষয়ে নতুন গল্প শোনার কথা নয়....
তবু ঝিরপাণির বাজারে সাঁওতাল মেয়ের ডালায় মোটা লালচাল দেখলেই
কাঠের আঁচে সেদ্ধ করা গরম ভাতের গন্ধ পাই..
দু'মুঠো ভাতের স্বপ্ন চোখে মেখে ঢেকিছাঁটা চাল নিয়ে খোলাবাজারে বসে থাকে  কালো দেবীমূর্তি...
আহা গো...দেবী বলে কথা...পুজো হবেনা?
অতএব নাটমন্ডপ, গর্ভগৃহ,যগ্গবেদী  তৈরী হয়..চাঁদমালায় ফুলহারে সাজে...
অন্নভোগ নিবেদন করে দেবীর ঠোঁট অব্ধি পৌঁছানোর তর সয়না
কাড়াকাড়ি করে নিবেদিত অন্নথাল শেষ করে দিই আমরা অমৃতের সন্তানরা...
ক্ষুধার্ত দেবী পুজাবেদী দুরত্বে আধপেটাই থাকেন বারোমাস...
দেবীর বানভাসি অশ্রুকে আমরা গঙ্গা ভাবি...পরম ভক্তিভরে হাতমুখ পাপ ধুয়ে আচমন সারি...
কৃষ্ণসার দেবীর স্বর্গে তৃষ্ঞার্ত শিশু...ক্ষুধার্ত আত্মজন...সম্বতসর ক্ষুধা উতসব...
ওদের স্বর্গ আর আমাদের মর্তের মাঝে গুড়িসুড়ি মেরে বসা কল্কি-অবতার
মহোতসাহে হাততালি দিয়ে বলতে থাকে "নারদ নারদ"!
-----------------------








জল: একটি বিষয় বহির্ভূত কলমচর্চা
মৌ দাশগুপ্ত
************
জলতর্পনের জন্য গঙ্গাজল খুঁজতে গিয়ে পথক্লান্ত ঠাকুমার ঘামেভেজা শীর্ণ মুখ দেখে
একটি বহুজাগতিক কোম্পানীর কোল্ডড্রিংক্স জমকালো পোষাকে নিজের দাম শুনিয়ে বাহবা নিচ্ছিল ..
দেশী আগমার্কা পানীয়র দল বাজারি চালে জোরগলায় বলছিল তাদের ঠিকুজি কূলকোষ্ঠীর বিবরণ...
ফলরঙ তকমার আড়ালে আরো  কিছু তরলপদার্থ চোখ ঠেরে বুঝিয়ে দিচ্ছিল পোষাকের নীচে লুকানো গুণাবলী...
ছিপি আঁটা পানীয়জল নামের ছাপোষা পণ্যরা হাতজোড় অনুরোধ করেছিলো তাদেরকে নিতে...
কিন্তু ঠাকুমা তো তখন নহবতখানা পেরিয়ে হাঁটুডোবা নদীজলে আকণ্ঠ তৃষ্ঞা মিটিয়ে
পূর্বপুরুষদের তিলাঞ্জলি  জলতর্পণটাও সেরে ফেলেছে...
আর আমি তখনও পারানির কড়ি ভেবে পকেটের জমা পুঁজি গুনতে গুনতে
একটি বহুরূপী  স্বপ্নের আসন্ন প্রসব সম্ভাবনায় মশগুল হয়ে দোকানে দোকানে তর্পণযোগ্য় জল খুঁজে বেড়াচ্ছি....
---------------------------------------








আসুন প্রবন্ধ লিখি
মৌ দাশগুপ্ত
*************
রঙিন ছাতা ও গোপনীয়তার ওপর প্রবন্ধ লিখে ফেলা যায় অনায়াসে
তাতে সমুদ্রতট..ঢেউঢেউ ঊথালপাথাল প্রেম..
এমনকি শীৎকারও লিখতে পারি...
ছাতার আড়ালে নিষিদ্ধ আপেলের স্বাদ গোপন রাখার আইডিয়াও মন্দ নয়....
প্রেমের চিঠি যে ছাতামাথায় ডাকপিওন দরজায় দরজায় বিলি করে যায় তার না পড়া চিঠিদের গোপনীয়তাও লেখা যায় অনায়াসে....
কিশোরী মেয়ে তার  ফুলছাপ ছাতার আড়ালে গোপন রাখে নরম ত্বক আর জ্বলন্ত সূর্যের অসম ভালোবাসা....
স্কুলপড়ুয়া শিশু তার লাল নীল ডোরাকাটা ছাতার নীচে একমুঠো চিনাবাদামে লুকিয়ে রাখে তার নিষ্পাপ  গোপনীয়তা'...
আমার নিজের কোন ছাতা নেই...
অথচ দু'পুরুষের ব্যাবহার করা ছাতার ভাঁজে ভাঁজে গোপন শব্দটাকে অনেক চেষ্টাতেও খুঁজে পাইনা...
-----------------------------------------








নীড়
মৌ দাশগুপ্ত
**************
জানলার ফ্রেমে বাঁধানো আকাশ আমার অবসর..
সুর্যাস্ত থেকে সূর্য্যোদয়
কিংবা হয়তো, তারও আগে, তারও পরে-
আমার চেনা পৃথিবীর পরিসর
ওখানেই আটকে গেছে আজ অনেক বছর।
যেন উড়ন্ত পাখির ঝাঁক থেকে পিছিয়ে পড়েছে একপাখি,
তার দুডানায় সংসার, জীবনের সহজ সরল ব্যর্থতার ভার,
ঠোঁটে কাঠকুটো, বয়ে নিয়ে চলে ছোট্ট বাসায়, গাছে,
আবার উড়ে উড়ে আসে আমার ঘরের কাছে....
জানলার নীচে প্রদীপহীন তুলসী গাছটা বাড়তে বাড়তে জঙ্গল,
ম্লান এই ঘর, পণ্যগ্রস্থ গার্হ্যস্থ, ভূতগ্রস্ত দিন,
দরকচা মারা শব্দের পারস্পরিক বিনিময়
তার সাথে ভীষণভাবে মানানসই শুকনো বনতুলসীর ঝোপ।
তবু সেই বনতুলসীর শুকনো কাঠকুটোতেই সুখী নীড় গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে,
চেষ্টায় কিনা হয়?
একদিন তুলসীতলায় জলটা আমিই দিতাম;
সংসারের মঙ্গলকামনায় জ্বালাতাম সন্ধ্যাপ্রদীপ,
আমি তুমি বিভাজনে এখন অভ্যাসবশত আমাদের হলুদ দাম্পত্য,
তাই ভরা  জ্যোৎস্নাতেও চাঁদের  আলো নীল ।আগাছায় ভরেছে ঘরদুয়ার..
আজ পাখির দেখাদেখি আরেকবার চেষ্টা করে দেখি,
আরেকবার তুলসী গাছে জল ঢেলে প্রদীপ জ্বেলে সাজিয়ে দেখি,
সূর্য্য ডোবার সময় নীড়গামী পাখির ঝাঁকে তুমি ফিরে আসো কিনা!
--------------------------------------------







রুদ্রাক্ষ-
মৌ দাশগুপ্ত
************
নদীর তীরে শ্মশানফেরত একলা এক মানুষ।
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত,পরিশ্রান্ত... মুখ ধুয়ে নিচ্ছে বহতী নদীজলে।
জল তো নয়, যেন বৃষ্টিলেখা মেয়ের আনন্দাশ্রু!
আঁকাবাঁকা দেহলতায় বেখেয়ালী  খুশিতে
জড়িয়ে ধরছে ঠিকানাভোলা পথের পুরুষালী শরীর।
বড় শান্ত পরিবেশ।
অদূরে চন্ডাল হরিশচন্দ্র একা চিতাদন্ড হাতে
লেলিহান শিখায় উড়িয়ে দিচ্ছে প্রিয়মানুষটির বড়প্রিয় অঙ্গপরশ,
মায়াময় চাউনি, সুগন্ধী এলোচুল, উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া।
ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস এখন অভিমানে পোড়া সুখ।
অগ্নিশুদ্ধ সোনার মত খাঁটি।
সামনে প্রসারিত অন্তহীন ধূলিপথ, মননে সব হারানোর শূন্যতা!
শেষ সহায় সেই বিষ্ণুচরণ, আঙুলে আঙুলে তর্পণমুদ্রা।
অনিমেষ দৃষ্টি, অন্তর্মুখী মননদীজলে ভেসে যাচ্ছে ভষ্মমায়া অহমিকা।
বিস্রস্ত জ্যোৎস্নায় অনিরুদ্ধ শরীরে তিলাঞ্জলি মুক্তি।
মৃত্যু তো শেষ নয়।
তারপরেও থেকে যায় মায়া-মোহ-মমতাহীন রুদ্রাক্ষ সংসার।