ব্লাড লিরিক
মলয় রায়চৌধুরী
অবন্তিকা, তোর খোঁজে মাঝরাতে বাড়ি সার্চ হল
এর মতো ওর মতো তার মতো কারো
মতো নয়
যেন এমন যেন অমন যেন তেমন নয়
কী করেছি কবিতার জন্য
আগ্নেয়গিরিতে নেমে ?
একি একি ! কী বেরোচ্ছে বাড়ি
সার্চ করে
কবিতায় ? বাবার আলমারি ভেঙে ব্রোমাইড সেপিয়া খুকিরা
কবিতায় । হাতুড়ির বাড়ি মেরে
মায়ের তোরঙ্গে ছেঁড়ে বিয়ের সুগন্ধি বেনারসি
কবিতায় । সিজার লিস্টে শ্বাস
নথি করা আছে
কবিতায় । কী বেরোলো ? কী বেরোলো ? দেখান দেখান
কবিতায় । ছি ছি ছি ছি, যুবতীর আধচাটা যুবা ! মরো তুমি মরো
কবিতায় । সমুদ্রের নীলগোছা
ঢেউ চিরে হাড়মাস চেবাচ্ছে হাঙর
কবিতায় । পাকানো
ক্ষুদ্রান্ত্র খুলে এবি নেগেটিভ সূর্য
কবিতায় । অস্হিরতা ধরে রাখা
পদচিহ্ণে দমবন্ধ গতি
কবিতায় । লকআপে পেচ্ছাপে
ভাসছে কচি বেশ্যাদেখা আলো
কবিতায় । বোলতার কাঁটা পায়ে
সরিষা ফুলের বীর্যরেণু
কবিতায় । নুনে সাদা ফাটা
মাঠে মেটেল ল্যাঙোটে ভুখা চাষি
কবিতায় । লাশভূক শকুনের
পচারক্ত কিংখাবি গলার পালকে
কবিতায় । কুঁদুলে গুমোট ভিড়ে
চটা-ওঠা ভ্যাপসা শতক
কবিতায় । হাড়িকাঠে ধী-সত্তার কালো কালো
মড়া চিৎকার
কবিতায় । মরো তুমি মরো তুমি
মরো তুমি মরলে না কেন
কবিতায় । মুখে আগুন মুখে
আগুন মুখে আগুন হোক
কবিতায় । মরো তুমি মরো তুমি
মরো তুমি মরো তুমি মরো
কবিতায় । এর মতো ওর মতো তার
মতো কারো মতো নয়
কবিতায় । যেন এমন যেন অমন
যেন তেমন নয়
কবিতায় । অবন্তিকা, তোর খোঁজে সার্চ হল,
তোকে কই নিয়ে গেল না
তো !
অবন্তিকা, তোর ওই
মহেঞ্জোদারোর লিপি উদ্ধার
মলয় রায়চৌধুরী
কী গণিত কী গণিত মাথা ঝাঁঝা
করে তোকে দেখে
ঝুঁকে আছিস টেবিলের ওপরে
আলফা গামা পাই ফাই
কস থিটা জেড মাইনাস এক্স
ইনটু আর কিছু নাই
অনন্তে রয়েছে বটে ধুমকেতুর
জলে তোর আলোময় মুখ
প্রতিবিম্ব ঠিকরে এসে ঝরে
যাচ্ছে রকেটের ফুলঝুরি জ্বলে
কী জ্যামিতি কী জ্যামিতি ওরে
ওরে ইউক্লিডিনী কবি
নিঃশ্বাসের ভাপ দিয়ে লিখছিস
মঙ্গল থেকে অমঙ্গল
মোটেই আলাদা নয়, কী রে বাবা, ত্রিকোণমিতির জটিলতা
মারো গুলি প্রেম-ফেম, নাঃ, ফেমকে গুলি নয়, ওটার জন্যেই
ঘামের ফসফরাস ওড়াচ্ছিস
ব্রহ্মাণ্ড নিখিলে গুণ ভাগ যোগ
আর নিশ্ছিদ্র বিয়োগে প্রবলেম
বলে কিছু নেই সবই সমাধান
জাস্ট তুমি পিক আপ করে নাও
কোন প্রবলেমটাকে
সবচেয়ে কঠিন আর সমস্যাতীত
বলে মনে হয়, ব্যাস
ঝুঁকে পড়ো খোলা চুলে
লিপ্সটিকহীন হাসি কপালেতে ভাঁজ
গ্যাজেটের গর্ভ চিরে তুলে
নিবি হরপ্পা-সিলের সেই বার্তাখানা
হাজার বছর আগে তোর সে-পুরুষ প্রেমপত্র
লিখে রেখে গেছে
মহেঞ্জোদারোর লিপি দিয়ে ; এখন উদ্ধার তোকে করতে হবেই
অবন্তিকা, পড় পড়, পড়ে বল, ঠিক কী লিখেছিলুম তোকে---
অমরত্ব অমরত্ব ! অবন্তিকা, বাদবাকি সবকিছু ভুলে গিয়ে
আমার চিঠির বার্তা তাড়াতাড়ি
উদ্ধার করে তুই আমাকে জানাস
সোনাগাছিতে
বৃষ্টি
মলয় রায়চৌধুরী
পাকানো সিঁড়ির শেষে, তিনতলার বাঁকে, বলল পিসতুতো দাদা
“এই হল সোনাগাছি, শহরের রাণি, ফি-রাত্তিরে পাঁচ লিটার
খোকাখুকু জমা হয় এ-পাড়ায়, ভেবে দ্যাখ, মৌজমস্তিতে নষ্ট
কতশত মহান পুরুষ-নারী, জন্মাবার আগেই খাল্লাস ;
ওই যে গুটকাঠোঁট মাসি, ওকে বললেই, যাকে চাস, নিস---
এখন তো চুলখোলা মেয়েদের নধর
দুপুর, সকলেই ফাঁকা,
হাফ রেটে সুন্দরীতমাকে পেয়ে
যাবি ; কাজ আছে, আমি চললুম ।”
‘ঘরে নয়, বিছানায় নয়, চলো না, কালবৈশাখিতে ভিজে
প্রেমিকার অভাব মেটাই’, বলি কালো মেয়েটিকে ।
চুড়িদার শ্যামলিমা আর আমি
কোমর জড়িয়ে
আহিরিটোলার ঘাটে ঝোড়োজল
গঙ্গায় নামি--
ও হয় ফোলানো পালের নৌকো, চিৎসাঁতার দোল খায়
আমি হই লগিঠেলা ভাটিয়াল মাঝি
।
‘আবার এসো কিন্তু, অ্যাঁ, প্রেমিকা ভেবেই চলে এসো
যেদিন পড়বে বৃষ্টি ; ভিতরে তো ভিজছি না
বাইরের ভেজবার দামটুকু দিয়ে
চলে যেও।’
আমার দেয়াল
মলয় রায়চৌধুরী
গগাঁ, সেজানে, রোথকো,
পোলক, পিকাসো, ভ্যানগঘ,
কুনিং, গুস্তাভ ক্লিন্ট, ফ্রান্সিস বেকন
হাঁ করে দাঁড়িয়ে বহুক্ষণ
দেখেছি ইউরোপের আর্ট
গ্যালারিতে
যতোবার আর্ট গ্যালারিতে গেছি
নিজেকে বড়োই ক্ষুদ্র ফালতু
ছোটোলোক বলে
গালমন্দ পেড়েছি বাংলায় ।
আশেপাশে দর্শকেরা ভেবেছি
বুঝি বিস্ময়
প্রকাশ করছি, মিলিয়ন মিলিয়ন
ডলারের ছবিদের রহস্য জেনে ।
টাকাকড়ি বাদ দাও--
একরুমের দমবন্ধ ফ্ল্যাটে
আমার তো নিজের দেয়ালও নেই
পাড়ার শিল্পীর দানে পাওয়া
পেইনটিঙ টাঙাবার;
আমার মতোই ছাতাপড়া পাপড়ি-খসা
রাস্তার ডিজেল উড়ে বাসি
নোংরা
ঝুলকালি জমিয়ে রেখেছে বুক
ভরে
বিল্ডারের ডিসটেমপারে আমার দেয়াল
।
নখ কাটা ও
প্রেম
মলয় রায়চৌধুরী
রবীন্দ্রনাথ, দেড়শো বছর পর একটা প্রশ্ন আপনাকে :
কে আপনার নখ কেটে দিত যখন
বিদেশ-বিভূঁয়ে থাকতেন…
সেই বিদেশিনী ? নাকি চৌখশ সুন্দরী ভক্তিমতীরা ?
যুবতীরা আপনার হাতখানা কোলের
ওপরে নিয়ে নখ
কেটে দিচ্ছেন, এরকম ফোটো কেউ তোলেনি যে !
ওকামপোর হাঁটুর ওপরে রাখা
আপনার দর্শনীয় পা ?
মহাত্মা গান্ধির ডানা রাখবার
দুই সাথিনেরা
বোধহয় কেটে দিত নখ ; কেননা বার্ধক্যে পৌঁছে
নিজের পায়ের কাছে নেইলকাটার
নিয়ে যাওয়া, ওফ, কি
কষ্টকর, আমার মতন বুড়ো যুবতীসঙ্গীহীন পদ্যলিখিয়েরা
জানে । প্রেম যে কখন বয়সের
দাবি নিয়ে আসে !
ফিসফিসে লোকে বলে সুনীলদার
প্রতিটি নখের জন্য
উঠতি-কবিনী থাকে এক-একজন । জয়
গোস্বামীরও
ছিল, তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে সমুদ্রের পাঁকে, দুই চোখ বুজে ।
চাইবাসার ছোটোঘরে শক্তিদার
নখ কেটে দিচ্ছেন প্রেমিকাটি
দেখেছি যৌবনে । বিজয়াদিদির
নখ কেটে দেন কি শরৎ ?
যশোধরা তোর নখ কেটে দিয়েছে
তৃণাঞ্জন কখনও ?
সুবোধ আপনি নখ কেটে দিয়েছেন
মল্লিকার পা-দুখানি
কোলের ওপরে তুলে ? কবি কতো একা টের পেতে,
তার পা-এ
তাকালেই বোঝা যায় । যেমন
জীবনানন্দ, হাজার বছর
খুঁজে চলেছেন কবে কোন বনলতা
নখ কেটে দিয়ে যাবে তাঁর ।