সম্পাদকের কলমে
না, করোনা নিয়ে কোন কথা নয়। অনেক কথা হল।
কিন্তু একটা বিষয় পরিস্কার। করোনা পূর্ববর্তী পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার আর কোন উপায় নাই।
আমরা এখন যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে, সেখানে কবিতাচর্চাও এখন একটা আহাম্মকি বিষয় বলে মনে হলেও,
ভুল হবে না। মানুষের জীবন জীবিকা অন্ন বস্ত্র বাসস্থান স্বাস্থ্য শিক্ষা সবই প্রশ্নচিহ্নের
সামনে দাঁড়িয়ে। বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ার মুখে। উৎপাদন স্তব্ধ। কৃষিকার্য বিপর্যস্ত।
খাদ্য সম্ভারে টান পড়তে শুরু করেছে। মহামারীর অবসম্ভাবী পরিণতি মন্বন্তর সামনে। মহামারীতে
প্রথম বিশ্ব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মন্বন্তরে বিপর্যস্ত হবে তৃতীয় বিশ্ব। আমরা সেই
বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। এই সময় হয়তো কবিতাচর্চার সময় নয়।
জীবনের সকল ভাঙ্গাগড়া বিপর্যয়ের ভিতরেও
মানুষের লক্ষ্য থাকে আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসা। সেই লক্ষ্যই হয়তো বিপর্যয় মোকাবিলার
অন্যতম হাতিয়ার। সেই দিক দিয়ে দেখতে গেলে, এই অসময়েও কবিতাচর্চার দরকার আছে বই কি।
দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামে যে শক্তির প্রয়োজন, সেই শক্তি আসতে পারে জীবনের অন্যান্য স্বাভাবিক
কাজ কর্মগুলির ভিতর দিয়েই। কবিতাও সেই স্বাভাবিক কাজ কর্মের ভিতরেই পড়তে পারে। না সকলের
ক্ষেত্রে অবশ্যই নয়। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই। সেখানেই এই অসময়েও কবিতাচর্চার যৌক্তিকতা
অস্বীকার করার উপায় নাই। নাই বলেই কবিতাউৎসব তার মাসিক কবিতা প্রকাশের স্বাভাবিক ধারাকে
বজায় রাখতেই প্রয়াসী। সেই প্রয়াস আরও কতদিন জারি রাখা সম্ভব হবে, সেকথা এখনই বলা সম্ভব
নয়। যতক্ষণ সম্ভব, ততক্ষণ সেই স্বাভাবিক ধারাটিকে সজীব সতেজ করে রাখার লড়াই করা যাক
না। অবশ্যই সেই লড়াই কারুর একার লড়াই নয়। সকলের সম্মিলিত লড়াই। সকলের সম্মিলনেই তার
সার্থকতা।
তবে একটি কথা না বললেই নয়। করোনা নিয়ে
এই বিশ্ববিপর্যয়ের মূল কারিগর কিন্তু ধনতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা। যে ব্যবস্থার ভিতর
বাঁধা পড়ে রয়েছে গোটা বিশ্বই। যার মূল্য দিতে হচ্ছে আবিশ্ব সাধারন মানুষকেই। কত লক্ষ
মানুষ বলি হলো। কত কোটি মানুষ অনাহারের সামনে পড়বে! তার কোন হিসাব নাই। কিন্তু আমরা
কেউই কি ভেবে দেখেছি, কেন হল এমনটা? আমরা কি খৌঁজ নিয়ে দেখেছি, জানুয়ারীর ৩০ তারিখেই
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা করোনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছিল? সেই সময়েই
প্রতিটি দেশের সরকারগুলির কাছে এই তথ্য পৌঁছিয়ে গিয়েছিল যে, করোনা মানুষ থেকে মানুষে
ছড়াচ্ছে। এবং সেই ছড়ানোয় প্রধানতম ভুমিকা নিচ্ছে আবিশ্ব বিমান পরিসেবা। বিমানবন্দরগুলিই
প্রতিটি দেশে করোনা ঢুকিয়ে আনার মূল ফটক। জরুরী এই তথ্যগুলি জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহেই
প্রতিটি দেশের সরকারের কাছে পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা সত্তেও প্রায় কোন দেশই
আন্তর্জাতিক বিমান পরিসেবা বন্ধ করেনি। ফলে করোনা দ্রুত হারে এক দেশ থেকে আরেক দেশে
ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। ফেব্রুয়ারীর প্রথমেই মাস দুয়েকের জন্য সকল দেশ আন্তর্জাতিক
বিমান পরিসেবা বন্ধ করে দিয়ে সকল বিমানবন্দর নৌবন্দর ও স্থলবন্দর বন্ধ করে বর্ডার সীল
করে দিলে করোনার এই বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হতে পারতো। এর ফলে সাময়িক ভাবে
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্তব্ধ হলেও অধিকাংশ দেশের অভ্যন্তরীন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জনজীবন
ব্যহত হতো না এমন ভাবে। একদিকে করোনাকে দেশের ভিতর ঢুকতে না দিয়ে, অন্যদিক দিয়ে স্বাভাবিক
জনজীবন স্তব্ধ না করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যহত না করেও করোনা মোকাবিলা করা যেত। দুঃখের
বিষয় কোন দেশই সেই পথে না যাওয়ায় আজ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনা হয়েছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জও যার দায় এড়াতে পারে না। মৃত্যু হয়েছে লক্ষাধিক মানুষের। এর দায় তো ধনতান্ত্রিক
এই বিশ্বব্যবস্থাকেই নিতে হবে। যে ব্যবস্থা প্রাথমিক পর্বে সঠিক পদক্ষেপ নিতেই পারেনি।
মনে করেছিল আন্তর্জাতিক বিমান পরিসেবা বন্ধ করে দিলে বিশ্ব অর্থনীতিই মুখ থুবড়ে পড়বে।
অথচ সেই কাজই শেষে করতে হলো, যখন সব কিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। যার ফলে আন্তর্জাতিক
ও অভ্যন্তরীন অর্থনৈতিক সব কর্মকাণ্ডই স্তব্ধ করে দিয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে বিশ্বব্যাপী
পরিব্যাপ্ত করা হলো সম্পূর্ণ অপদার্থতার সাথে। আর তখনই প্রশ্ন জাগে। এই অপদার্থতা অপদার্থতাইতো?
কোন সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা প্রসূত নয় তো? নয়তো আবিশ্ব সকল দেশই চীনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ
করেও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সর্বোচ্চ সতর্কতা সত্তেও সঠিক সময় সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ
হলো একই সাথে? প্রশ্নগুলি এবার হয়তো তোলার সময় হয়ে গিয়েছে। এই সময়ের কবিতাচর্চাকেও
এগোতে হবে জীবনের এমনই কঠিন বাস্তব থেকে। নয়তো সেই কবিতাচর্চা শব্দের কঙ্কাল হয়েই অক্ষরের
স্তূপ স্ফীত করতে থাকবে মাত্র।
কবিতাউৎসব জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭ পঞ্চম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা