মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২০

তনিমা হাজরা


তনিমা হাজরা

পুতুল খেলতে খেলতে

আসলে আমরা সবাই
পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করি,
কাউকে কাছের ভেবে মায়ারজ্জু দিয়ে
তার সাথে নিজেকে জড়াই,
তার আরশীতে নিজেকে দেখি।
তাকে সাজাই নিজের ইচ্ছে মতো,
তাকে যত্ন করে তৃপ্ত হই,
তার সাথে মনের কথা বলি,
অভাব অভিযোগ রাগারাগি,মান অভিমান  সবকিছু।
এমন একজন কেউ যাকে ভরসা করে নিশ্চিন্তে
পথ হাঁটে আমাদের লতানে গহন মন।
ডাকলে যার সাড়া মেলে অতলান্ত অন্তরাত্মা থেকে।
সে হতে পারে প্রেমিক অথবা ঈশ্বর।

আসলে আমরা সবাই পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করি।
যাদের একজন সত্যিকারের প্রেমিক থাকে,
তাদের ঈশ্বর লাগে না।
কারণ আকুল প্রেমিকের মতো
স্বচ্ছ ঈশ্বর আর কেউ নেই।।






হজমীগুলি আর মৌচাকের গল্প

মেয়েটিকে ওরা দজ্জাল বলেছিলো,
কারণ "সুশীলা" বালিকাদের মতো
হজমীগুলি খেয়ে  ঢেকুর তুলে ঘুমিয়ে পড়ার মতো
আন্ত্রিক দক্ষতা ওর ছিল না।।

মেয়েটিকে ওরা চরিত্রহীন বলে প্রচার করেছিল,
কারণ চরিত্রের চাটনি একটি
অত্যন্ত সুস্বাদু রেসিপি।

মেয়েটিকে ওরা একঘরে করে দিতে চেয়েছিল,
মেয়েটি নিরাসক্তভাবে ভেবেছিল,
মৌমাছিদের অযথা কোকিলের দর্শনতত্ত্ব বুঝিয়ে কি লাভ।।।







শ্রমিক

আমি একটি বাক্যের ভিতরে বাস করি,
যেমন করে একজন খেটে খাওয়া মানুষ
সারাদিন হা-ক্লান্ত হয়ে এসে
গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ে
তার সীমিত চৌহদ্দির ভেতর।।

পায়ের পাশ দিয়ে আরশোলা,
গুটিকয়েক পিঁপড়ে তারই উচ্ছিষ্ট খুঁটে খেয়ে
ফিরে যায় হেলতে দুলতে।
দেওয়ালে টিকটিকি সারারাত
ফাঁদ পেতে বসে থাকে।
দৈনিক বরাদ্দের তেল ফুরিয়ে গেলে
দপ করে নিভে যায় ভাঙাকাঁচ
বিগত যৌবনা লন্ঠন,
মশারা প্রাপ্য রক্ত হিসাব বুঝে
শুষে নিয়ে ডিম্ব নিষিক্ত করার কাজে যায়।।

এই শ্রম আর ক্ষুধাই আমাকে রোজ ঘুম পাড়ায়,
জাগায়, ছুটিয়ে মারে জীবনের পিছনে পিছনে।।

আমার বাক্যে বিশেষ্যপদ তুচ্ছ,
বিশেষণ বিষাক্ত, ক্রিয়াপদ মুহ্যমান,
অব্যয় সম্পূর্ণরূপে ব্যায়ের খাতায়।।
তবু জীবনের প্রতি কি প্রগাঢ় ভালবাসা,
কি তীব্র মরণকামড়।।

অথচ দেখো এতবার মুছে দেবার পরও
আমার বাক্যের অক্ষরগুলি কি অমোঘ হয়ে
জ্বলজ্বল করছে রাত্রির আকাশে ।।।






শুধু কি বয়ে গেছে

কতো যে
পায়ের ছাপ পড়েছে রাস্তায়,
পাহাড়ে চড়ে, ঢালুতে নেমে যায়,
মাঠের সবুজ মেখে ধূলোতে থিতিয়ে  যায়,

কার পায়ের নীচে কতটা জমি নিরাপদ,
কার কানের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে শ্বাপদ,

নক্সীকাঁথার মাঠে,
কে যেন জমায়েত হতে  ডাকে,
শহরের আলো জ্বলে,
সারারাত,
আমাদেরই ভেতরে ভেতরে 
আলো নিভে আসে একে একে।।

কে যেন বন্ধু ছিল অনেক দিন আগে,
তারপরে, পর হয়ে গেছে,
রয়ে গেছে তার স্পর্শ, ঘ্রাণ, ছবি
পাঁজরের এপাড়ে ওপাড়ে,
এখনো দাঁড় টেনে দেখি,
নদীতে তো নাব্য জল আছে,

তবে কেন  ভাঁটা এলে বালির ওপরে,
মরা মাছ ভাসে,
ঠুকরে খেয়ে যায় সন্ধানী চিল,
এখনো রোদ ওঠে,
পাড়ের গাছ ঘেঁষে,
এখনো সকলে চান করে যায়,
গ্লানি ধুয়ে, নগ্নতা ডুবিয়ে,

স্নিগ্ধতা ছাড়া আর কি দিতে পারি,
চানের অভিপ্রায়ে সবাই স্নিগ্ধ হয়ে
মলিনতা জমা দিয়ে গেছে,
এ স্রোতস্বিনী জল, মনে তার রাখেনি কিছুই,
শুধু বয়ে গেছে, শুধুই বয়ে গেছে।

পাড়ের ধারের মাটি কখন ক্ষয়ে গেছে,
এ স্রোতস্বিনী জল যেতে যেতে 
চুপিচুপি কুরে কুরে খেয়ে গেছে,

পলির ভেতর ভেতর লুকোনো স্মৃতিকথা 
পরতে পরতে আজ পাথর হয়ে গেছে।
নদীর দীঘল স্রোতের তলায় একা একা একান্তে
একাধিক সংখ্যক শ্যাওলা গায়ে মেখে
যুদ্ধ সাজ সেজে অচেনা হয়ে গেছে।।