মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০১৯

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়


হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

দুপুরের বর্ণপরিচয় ১

দুপুর মানে কি শুধুই অবিরাম দুর্বোধ্য শাসন? শুধুই কি চকচকে আলোয় একটানা নৈঃশব্দ্যের গান গেয়ে যাওয়া? দুপুরের গা দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা নদী। বড় বড় নদীর গায়ে ধাক্কা লেগে যে এখানে ছিটকে এসেছে। দুপুরের দিকে তাকিয়েই যে একমাত্র বর্ণপরিচয় শেখার সাহস পেয়েছে। নদীর শরীর থেকে উঠে আসা একপ্রকার জলজ হাওয়া যেদিন দুপুরের গায়ে একটা স্যাঁতস্যাঁতে আস্তরণ ফেলে দিয়েছিল ঠিক সেদিনই তার শোবার ঘর থেকে ভেসে এসেছিল নবজাতকের কান্না। গাছতলায় বিশ্রামরত পথিককে কথা দিয়েছিল হেঁটে যেতে যেতে সে পর্যাপ্ত গল্পের যোগান পাবে। মধ্যাহ্নেও কেউ কেউ পেতে পারে অপরাহ্ণের প্রশ্রয়। দুপুরের প্রবন্ধ লিখতে বসে উপসংহারে যে কখনও কখনও ঝেঁপে বৃষ্টি আসে তার মূলে ওই নদী। খুব কাছে গেলে দুপুরের শরীরে তার একটা হালকা দাগ পেলেও পেতে পারো।








দুপুরের বর্ণপরিচয় ২


একমাত্র দুপুরেই বেশ কয়েকবার শুনেছিলাম তোমার বাঁশি। সেই বাঁশিতে তোমাকে যতখানি না চেনা যায় তার অনেক বেশি দুপুর আমার কাছে এসে জড়ো হয়। তবুও কেন বাঁশি তোমাকে চেনালো? তখন তো সবেমাত্র সকাল। ছাদের আলো আর মাটির আলোর পার্থক্য বুঝি না যে আমি সেই আমিই আবার দুপায়ে দাঁড়াতে পারব এই ভরসায় মাটির আলোতেই দিয়েছিলাম ডুব। কিছুটা এগিয়ে যেতেই তো তোমার বাঁশি। সুর কানে আসছে। তখন তো দুপুরের অনেকটা কাছে পৌঁছে গেছি। শুরু হয়ে গেছে ধৈর্য্যের পরীক্ষা। তোমার বাঁশিই দুপুরকে নতুন করে চেনালো। তুমি যে দুপুরকে খুঁজে খুঁজে ফিরেছ তোমার বাঁশির চলাচল তা বলে দেয়। বাঁশির সুর তো পথ। দিগন্তে পৌঁছে যাবে বলেই যে চৌকাঠ পেরিয়েছে। দুপুরের ক্যানভাসে যে এঁকেছে অবকাশের রেখাচিত্র। রেখা মানে তো জলরঙ। রেখা বরাবর দুপুরের শরীরে কত ফাঁক। দেখতে পাই সেখানে কত না বলা গল্প। চিরকালীন দুপুর ক'জনকেই বা বুক চিরে দেখিয়েছে তার আলোপথের গল্প। তোমার বাঁশি যেন সেই তুলি যে অভিযানের প্যালেটে ডুবে গেছে রুক্ষ ব্যস্ততার ক্ষেত্রে সবুজ ধানশিষ হয়ে দুলে উঠবে বলে।







আঙুলে আঙুলে রঙ


আঙুলগুলো আমার চোখের সামনে এক একসময় রেখা হয়ে ওঠে। মাটি থেকে ক্রমশ যেন তারা ওপরের দিকে উঠছে। আমি তাদের উৎস খুঁজি। ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়ে ফেলি। কিন্তু কোথায় তাদের শুরু?
     আঙুলগুলো আমি কতটুকু চিনি? তারা কি আমার স্বজন? দশ আঙুল দিয়ে যখন বুক চেপে ধরি তখন কেন সবসময় তারা আমাকে স্বস্তি দেয় না। তাহলে কি তারা আমার খুব কাছে থেকে আমাকে চিনে নিয়েছে? আমার দেহের প্রতিটি রক্তবিন্দুর বর্তমান কলুষতা কি তাদের স্পর্শ করেছে?
     আঙুলগুলোকে মাঝে মাঝেই আমি চিনতে পারি না। আমার চোখের সামনেই তারা আস্তে আস্তে রেখা হয়ে যায়। সকাল, দুপুর তারা আমার কাছ থেকে রঙ চায়। আমি দিতে না পারলে তারা আঙুলে আঙুলে অচেনা হয়ে যায়। সাদা পাতা পেলেই তারা পাতাজুড়ে রেখায় রেখায় ভাগ হয়ে যায়। আমি অবাক হয়ে দেখি আমার দেহেরই কিছু অংশ আমাকে অস্বীকার করার তীব্র ইচ্ছায় কী ভীষণ গতিতে পাতায় পাতায় বদলে ফেলছে তাদের গতিপথ। বুঝতে পারি শাসন বদলে গেছে।    
     আমি রঙ চিনি। আমি আঙুলে আঙুল ধরি। বলি, এসো আমিও তোমার সাথে রেখা হয়ে ছুটবো। সে একবারের জন্যও পিছন ফিরে তাকায় না। অসংখ্য বিমূর্ত রেখায় সে তার আগামীর কথা বলে। রঙ রেখার থেকে অনেক দূরে থাকা আমি চারপাশ দেখে নিয়ে অতি সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলি ।