মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০১৯

গোপাল চন্দ্র সাহা



গোপাল চন্দ্র সাহা

গ্রিনিচ রেখার আশেপাশে 

১)
কখনো এক অথবা দুই চক্ষু দূরত্বে বসে বসে বাতাস গুনছে অবাক বালক
বাতাস জনে-জনের শরীর ছুঁয়ে নির্নিমেষ হচ্ছে শঙ্খ শব্দের একাগ্রতায়

একটু পরেই শব্দ থামিয়ে রাত্রি ঝুলে যাবে ঘড়ির কাঁটায়, নিঃশর্ত
বয়ঃপ্রাপ্ত হতে হতে গিলে খাবে উল্কা পোড়া ছাই
অবলুপ্ত হয়ে যাবে 'নির্বাক' -- অবাক বালকের

২)
দুই হাতে টেনে রেখেছে দুই প্রান্ত, জনপদের
মাঝখানে ঝুলন্ত রসা - উদয়াস্ত
রসা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে থ্যাতলানো ছায়া - শূন্য 'ডিগ্রী' অবস্থানে

শূন্য ডিগ্রীর চারিদিকে হিব্রু ও অধুনা অপভ্রংশ :
এই মিশ্র-যজ্ঞের এক চিমটি প্রচেষ্টা
হয়ত মুছে দেবে ললাটের অতৃপ্তি, অবাঞ্ছিত

৩)
গ্রিনিচ রেখার ৩৬০ ডিগ্রী পরিবৃত্তে ছুটন্ত ট্রেন
ট্রেনের বাইরে দৃশ্যকাব্য -- পরাগত তথাস্তু-ভূমি
                      অথচ যাত্রীরা পরস্পরের অদৃশ্য

কুয়াশার অর্ধ-পূর্ণ বিশ্বাসে রাত্রি অথবা ভোরের আবরণ -- ক্রমশ ঢেকে দিচ্ছে বালকের বিস্ময়
                             সাইরেনের পিছুটানে লক্ষহীন গন্তব্য

৪)
গ্রিনিচ রেখার আশেপাশে আর কিছুই নেই  :

শুধু টেরাকোটা প্রহর  -- উঠোন, মাঠ, ভূবনের আলে-খালে
নীচে মিশছে থেমস্ নদী আর গঙ্গার জল
গুলে নিয়েছে খানিক সূর্য, চন্দ্র অথবা অন্ধের রং

তাই, অবাক বালক বিস্মিত হতে চেয়ে নিজেরই বিস্ময়ে
মাটির স্থিরতায় এঁকে দিচ্ছে পায়ের চিহ্ন, যন্ত্রণার মুদ্রায়    ।।








একটু হলদে আলো চাই

যেদিকে চলেছি, অপেক্ষার শেষে এক প্রাকার । একলা বাড়ির কিছুটা আকার । দাস দা'র খুঁটে খাওয়া দোকান । এটা ওর সংগ্রামের অংশীদার ।

চপ, বেগুনী, চা, হালফিলের পকোড়া । আর বৈকল্যময় গুঞ্জন, বিকেলের । গলি এসে বিকোচ্ছে এই মোড়ে, অথবা গ্রহপুঞ্জরা ।  মূল্য নির্ণায়ক --  এক-পৃথিবী-অন্ধকার ।

ওপরে জ্বলজ্বলে হান্ড্রেট ওয়াট । হলদে বাল্ব । হলদে পথে ঝরে পড়ছে প্রাগৈতিহাসিক বৈভব । ফোকাস করছে একটি জীবাশ্ম-পাথর । পাথরে জীবনবোধ, সহস্রাব্দের ।

আমি দেখছি একটি মঞ্চ । দাস দা খাতায় মগ্ন । কুঞ্চিত মুখে ধরে আছে প্রবঞ্চিত সুখ । প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেব নিকেষ, এযাবৎ । একে একে তুলে রাখছে নিশ্বাসে ।

কিসের হিসেব ? কে করবে পরিশোধ ? কেবা ফেরাবে -- উৎস হারানো নদীর স্রোত ? এই পথ যে সংশয়ী, রুক্ষতার নিয়ামক । দৃশ্যান্তরে টুকে রাখছে সব । অথবা হয়ত জানে - ওসব আসলে কিছুই নয় ।

হাড় ও কাঠের ঘর্ষণে জ্বলে উঠলে স্ফুরণ -- পদ্ম কোরক নয়, এই ঘাসফুলের আঘ্রাণই শেষ স্তবক ।  হলদে আলোর এ' পথেই নেমে আসে গতির জাড্যতা ।

প্রকম্পিত হচ্ছে একটি শব্দ আভাস 'ওহে দাস ! এবার গোটাও তোমার তৈজস -- তোমার আকাশ, তোমার প্রকাশ ...'

ফিরে এলাম গন্তব্যে । অজান্তে, নিঃসাড়ে । টেনে নিলাম তল্পি শরীর সময়ের সানু দেশে । কেদারায় রেখে দিলাম এযাবৎ সঞ্চয় -- সকাল থেকে ভোরের অব্দ ।  সয়ংক্রিয়তায় খুলে যাচ্ছে প্রবৃত্তি পরত । অথচ হিসেব মিলছে কই ?

ও দাস দা ! একটু ফোকাস কর তোমার হান্ড্রেট ওয়াটের সূর্যটা ! -- এতএত বজ্রবিদ্যুত , অথচ ছিটকে আসছে অন্ধকার !

একটু হলদে আলো দেবে ? আমি সেই থেকে পেতে রেখেছি -- একটি ঘাসফুলের বিছানা !!








হাতে চাল, একমুঠো

ভাত গলিয়ে সুতোয় মাঞ্জা । ঘুড়ি আকাশ রঙা । উড়িয়েছি দূরন্ত । নজর রাখছে সূর্য-সীমান্ত । বোধয় আরেকটু হলেই পুড়িয়ে দেবে । দিক না দিক, পুড়িয়ে দিক ! নেমে আসুক মেঘ । মেঘ নেমে এলে প্রথমে ধান । তারপর চাল । আমার একমুঠো হলেই হবে । আবার মাঞ্জা দেব ।  আকাশে তখন ঘুড়ি, শুধু ঘুড়ি । ছুঁয়ে দেবে দূরত্ব ।
একটি অনিন্দ্য বৃক্ষ, ফুটে আছে চাঁদফুল । ঘুড়ি নিশ্চিন্ত । হাতে চাল, একমুঠো ।
ওরে কে আছিস কোথায় ! এবার কাট দেখি আমার সূতো !!








এই পরিচয়হীন নগরে

এলোমেলো বাতাস আজ অর্পিত হল এ'ভাবে  --
রেখে দিল ঝড়ের ভূমিকা মরুভূমি আর সবুজে

রেখে দিল সরস, বিরস অনুমান - বাঁশির দোষ-ত্রুটি অভ্যাসে

কেউ জানে বাতাসের কেন এত মান-অভিমান ?

কখনো মৃত নগরে যে ছড়িয়েছিল আনন্দ-আঘ্রাণ
ক্ষয়ে গেল হৃদয়, ক্ষয়ে গেল চন্দন-প্রাণ নির্দয়ী পাথরে
#
কাল অহর্নিশ পুড়ছে একচালা, ধূলোটসন্ধ্যার বন্ধনে
অরুন্ধতী কি ছিল সেখানে ?
তবে কেন এত মেঘে মেঘে তার বজ্র-অভিমান ?

পড়ে আছে কাদম্বরী নুপুর, পাশে অচুম্বিত ঝর্না ফুল

বেঁচে থাক তুই যেখানেই থাক, ছিন্ন যোনি নিয়ে
সপ্তর্ষি নাহয় আজ দগ্ধ হবে অপদহন-উত্তাপে
#
সৃষ্টির পরিচয় যতই মুষ্টিবদ্ধ হোক অমৃত  অহংকারে
সৃষ্টি তো মৃত্যু-শিল্পী -- অনাদি অনন্ত কাল ধরে পাথর টেনে তোলে নিজেরই পিরামিডে

এখন নগর এসে দাঁড়িয়েছে মৃত আকাশের মন্ডপে
সর্বাঙ্গে পুরাতন ধূলোর পরিহাস, নির্লজ্জতা দগদগে

নদীর শেষ সূর্যাস্তে শুষ্ক-শিশির রেখা জমা হলে
নিবিড় হয়ে ওঠে মহাকাল -- এই পরিচয়হীন নগরে ।।









প্রাত্যহিক যাপন

১)
জ্বালিয়ে ছিলাম আলো ।  অথচ সন্দেহ মোছেনি । আরও গাঢ় হল দৃষ্টি সীমার অন্ধকার । যেটুকু মুছে ফেলেছি, আঁজল ভরে নিল জোনাকিরা । ওরা গড়ে তুলল ছায়াপথ, ধীরে ধীরে, শতাব্দী ধরে । আমি নিয়ে এলাম ফুলেল হাওয়া, গত অব্দের, ভুবনের বৃন্ত থেকে । এখন, এই ছায়াপথই আমার আবাস, আমার সানন্দ । এখানে নদীর স্মৃতি থেকে চলকে পরে আবহমানকাল ।  ভেসে আসছে পাল তোলা গান ।  শুনতে পাচ্ছি কোলহলে প্রাচীনের সৌষ্ঠব ।

২)
এই নদীর পাশে কল্পলতা গাছ । গাছের নীচে ইতস্ততঃ সাদা পালক । বানালাম একজোড়া পাখসাট । জুড়ে নিলাম গায়ে । জুড়তেই পাখির চেতন । ডানা ঝপটাই আকাশে, সমান্তরাল মেঘে মেঘে । চাঁদের বাগানে সান্ধ্য ভ্রমন ।
এখানে অবান্তর মাটির দৃশ্য - কায়াদের দুঃখ । এখানে বসবাস নেই বিবস্ত্র ক্ষুধার্তের । কামনার কোন ইঙ্গিত নেই কর্নিকা প্রবাহের ।

                   :   সব সুখেও তো একটা দৃশ্য থাকে --
                       যে ঘুম ভাঙ্গায় স্বপ্নের,         সময়ে  :
৩)
চকোর গিলে নিচ্ছে জ্যোৎস্নার রস, সযত্নে সাজানো পট থেকে । সরে গেল চাঁদ । আমি অপরাগ ভৈরবী-শিহরনে । তবু চোখে জ্বেলে দিল দাবানল, নির্নিমেষ কাঁচরোদ । পুড়ে গেল সব । মাথার পাশে পড়ে থাকল ভস্ম, বিচূর্ণ ছায়াপথের । কি আর করা ! মেখে নিলাম এই প্রজন্মের অভ্যস্ত শোক ।

এখন সিঁথির দুপাশ কঠিন হাওয়ার স্রোত । ধূলো মেপে নিচ্ছে পথ, ঘূর্ণাবর্তের ।  আবার ডুব দিলাম আবর্তে । প্রেক্ষাপটে আলুথালু স্মৃতিরেখা । মুষ্টিবদ্ধ রিখটার স্কেল । আমি মেপে নিচ্ছি কম্পাঙ্ক -- প্রাত্যহিক যাপনের ।।