মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০১৯

সম্পাদকের কলমে রত্নদীপা দে ঘোষ



সম্পাদকের কলমে

এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, তখন সূর্য দুর্দান্ত।   মহা রোশনাই। আলোর, তাপমাত্রার। উচ্চারণের। উত্তপ্ত বাতাস। কড়ির দামামা। তার মাঝেই, মন্দ্রমধুর দিগন্ত খুলে হাজির, প্রিয় পঁচিশে বৈশাখ। জন্মদিন কবির। বাঙালীর পরতে পরতে সেই কবির তিথি-নক্ষত্র, পরাজগতের অপরা আভা। আবহাওয়া। জলবায়ুর দোসর এবং চিত্রদর্শন। চিরন্তন প্রকৃতিতে রবিবাবু মিশে রয়েছেন যে ভাবে, তাঁর কবিতায় গানে দুঃখবেদনে, আনন্দ-ঝঞ্ঝায়। দূরবাঁশীর নৈকট্যে। রক্তের পাটীগণিতে, পরমা-প্রকৃতির বীজধারে। তিনিই এক এবং অদ্বিতীয় গ্রন্থন।মেঘের মতো। বৃষ্টির মতো কুলুকুলু। নদীর মতো আবার পাহাড়েরও মতো সীমাহীন ঝরে-যাওয়া পর্ণমোচীর ধনেশ। রসদের অকাতরে, আগুন যেমন আছে, মশালের অগ্ন্যুৎপাতও আছে। বনের মধ্যে যে বৃক্ষটি শ্বাস নিচ্ছে তার শনশন দিয়ে গাঁথা হচ্ছে জীবনরসের মাধুরী। নিকট দূরটি আরও দুরের লাবণী। মনে হচ্ছে, সম্মোহিত পাঠক যেন এই বলাকার নিজের হাতে গড়া পান্থজন। কারাগারের পাঠচক্র খুলে মুগ্ধ ব্যাকরণের ধ্বনি, কবির জন্মদিনের রঙ্গনে, আন্তরিক বইছে অপঠিত প্রতিধ্বনির সুষমা। আকার তার আলাপনের হিজল, আকাশতলায় কলমের চাক-মৌ। আলোছায়া। গাছপালা। ব্রজবুলিতে তুমুল ক্যানভাস। ফুটে আছে পরিপূর্ণ কানায় কানায় তারামণ্ডলী। প্রাণের, ত্রাণের। ঘরোয়া জাদুর মধুর আসক্তি। রক্তের মধ্যে নতুন এক দেশ আবিষ্কার হচ্ছে। কুসুমের আপাদমস্তকে নতুন চালচিত্র। রাঙারজনীর চতুরঙ্গ। ভোরের বেলাটি যেন টুপটাপ গীতাঞ্জলী। সরল এক বালক। অনন্ত জগৎ যার উত্তরণের মুরতি। সাধকের স্বপ্নের ভেতর থেকে জন্ম নিচ্ছে সৃষ্টির কণ্ঠস্বর। সেই উচ্চারণগুলিই ভাসিয়ে দিচ্ছে আলেখ্য গীতির অলৌকিক হারমোনিয়ামটি। বলছে, চলো পালাই। একগুচ্ছ পালাই।

মন বলে, পালাবো কোথায়? আমার চারিধারে মোহজরার জরিদার সংসার, ক্লেদ রাজনীতির। রণাঙ্গন যেন। আমি, আমরা। প্রত্যেকেই  হারিয়ে ফেলছি নিজেকে। পালাতে চাই, কিন্তু কোথায়হারমনিয়াম বলে, আমার হাত ধরো, পালাই চলো পৃথিবীর অলিন্দ দিয়ে গমকের সুতনুকা ছুঁয়ে। গানসরণীর অন্তরীক্ষ ঘুরে, ডানদিকের নিলয়। সামান্য বাঁ দিকে গেলেই নিরুপম আলোর ফাৎনা। ধ্রুপদী উপাসনার জামদানী। অলংকারহীনতাই যেখানে আসল অলঙ্কার। অনঙ্গ ইঙ্গিতে বোঝাই এই সৌরঝঙ্কার। নির্ভার অংগরাগ। রাগকেশরের সততা সাদাপায়রার হাসি আর তামাশা। মনে হয়, বেঁচে থাকি। আরও দীর্ঘঋতু, বরষ মাস আর উপুড় করা ঘণ্টামিনিটের বরজ। বাঁচি আরও অনেক অনেক আলিঙ্গন। আহা! অমলিন ঢেউ ফুটফুটে তরঙ্গকিশোরী, তোরঙ্গ মেলে দিলেই এই বাউলে-রাস্তা, বাদলসুরের সঞ্চারীতে আঁকা দেবদেউলটি। লেখনী কার এমন প্রবল সম্রাট, জানি নে। অক্ষরজ্ঞান কার এমন তপ্তসেতারের বিনোদন, তাও জানিনে। ভেতরের সুরশিল্পীকে জাগিয়ে তুলছে কে, কার সাম্রাজ্য এমন লেলিহান অগ্নিশিকারের আয়োজন। প্রতিনিয়ত তাঁকে খুঁজে যাওয়াটাই যেন নিয়তি-লিখন। যখন চারদিকে থইথই করছে কড়াপাক- তুমুল টানাপোড়েন। সঙ্কট। প্রত্যেকেই চাইছে, আরও বিশাল হোক, ব্যাপক আকার ধারণ করুক তার নিজস্ব রাজপ্রাসাদের মসনদ ... তখন ভয় হয় যারপরনাই ... তাহলে কি আমরা হারিয়েই গেলাম? মুছে গেলো গানগীটারের তবলাবাদক? মুছে গেল অমর-প্রদীপ, ঋষিঝর্না, লেখনীর কামনায় উদ্বেল বইগ্রন্থের তুলি? ভালোবাসার বুলবুলিগুলি। সবাই কি নিভে গ্যালো? এমনকি ছোটখাটো চেহারার নদীরাও গেলো শুকিয়ে?

হাঁটছি না আর কেউ। যেন পথরাস্তার সৌন্দর্যদের অবলোকন করতে ভুলে গিয়েছি। শুধু দৌড়। ছুটছি। ডানার দিকে ছুটছি। পাখিপ্রবণতায় ছুটছি। পাখি হতে পারছি কই? সেই যন্ত্রণাও বেদন দিচ্ছে প্রচুর। চোখ মুছছি, এমন ভাবে যেন সেই ছড়গুলিকে কেউ দেখতে না পারে। আমরা ভুলে যাচ্ছি, হাসির মতো কান্নাও জীবন ধারণের জন্যেও খুব জরুরী। ভালো করে হাসবো কী করে, যদি কান্নাকে ভালবাসতে না শিখি। কান্নাও তো আমাদেরি আলাপন। খাম্বাজে গাওয়া কান্নার অশ্রুগুলি যে আমাদেরি আয়োজন, এটাও ভুলে যাচ্ছি। সমর্পণের হংসধ্বনি কতোদিন গাঁথা করিনি। বুকে তুলে নিইনি জলাশয়ের প্রতিবিম্ব। নিজের ছায়া নিজেই হইনি কতোদিন। তিন হাজার মাত্রার ঘাম ঝরাতে ঝরাতে কতদিন কৃষিবাস করিনি। ফুলদলের আচমকায় মিশিয়ে দিইনি আমাদের নিজস্ব হঠাৎ। পাগলামির ফসল। কোরাসের দুপুরে স্থানীয় স্থলপদ্মের খোঁজে বহুদিন অমলতাসের সঙ্গে মিত্রতা বাঁধা হয়নি। মানানো হয়নি মানুষ হবার উৎসব। নিজেকে নিয়েও উৎসব সাজাইনি ... বহুযুগ ... চারদিকেই অন্ধকার। প্রত্যাখানের নালানদ। ভয়ঙ্কর কাদার মিথেন। জড়িয়ে যায় পায়ের ভুরু। ভূগোলের রং, নিভে যায় ইতিহাসের সিঁথি। মনে হয় তখন, আরও একবার, তুমুল পিতামহের আকারে বেঁচে উঠি। হুঙ্কারের ছাদে, মেরুদণ্ড সিধে রাখি। উঠে দাঁড়াই, কলরোলের প্রতাপে। বৃষ্টির পাকস্থলী খুঁড়ে, শুরু করি নতুন সরবত-রচনার এপিটাফ, রেচনের পক্রিয়া শুরু হোক নতুনগন্ধের আমনঘাসে। পাতায় লতায় কোয়েলের শিশির। দরজার মুথাস্রোত। যেন আরও একবার শুরু হচ্ছে সাল্ভাদোরের আলেয়া। একে একে ভায়োলেট-রেড আর নীলব্লু। নতুন রসায়ন জেগে উঠছে, চরাচরের গায়ে মাথায় ভিবজিওরের গেরস্থালী। পরিস্কার চেনা যাচ্ছে কাঁধে কাঁধ রাখা প্রত্যয়ের রামধনু। উল্লাসের তর্জনী শুনছি। পারিজাতে। বৃক্ষে। জলসিঞ্চনে। মাধবীগাছের চারাগুলিকেও শুনছি এখন দুহাতে। বিষুবপক্ষের রোহিণীতারা, সাজিয়ে রাখছি মৌসুমি বারান্দার টবে। অমোঘ স্বরবর্ণের তাপমাত্রাগুলিও এখন অরণ্য গাইছে, তাদের পরনে মাত্রাতিরিক্ত স্বরবর্ণ। মহাজাগতিক শাড়ি ঘেরা স্বয়ং মহাকাশ, আমাদের প্রিয় শিক্ষিকা। সাজিয়ে দিয়েছেন এক ধ্রপদী পাঠশালা। সেই কিরণেই প্রখর, আমাদের তিন ছাত্রবন্ধু অরুণ বরুণ আর মনিমালা ...

আমরা ভুলকাতরের চন্দ্রবিন্দু থেকে ফেরবার ফিরে আসছি স্লেট আর পেন্সিল হাতে। ফিরে আসছি রজনীগন্ধার প্রাতে, বিউগল-স্নিগ্ধ অলীক উপহারের বেশে। যেন বায়স্কোপ, এক অলীক প্রবন্ধ। আমরা ভাবছি ছুঁই কি না ছুই? ধারাপাত গড়ি? নাকি ভূমধ্য অঞ্চলের টেনিস-ঘড়ি ...এইসব অপ্রাকৃত উপন্যাসগুলি ভাবতে না ভাবতে, বড় হয় আমাদের তেষ্টার পিয়ানো। আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি পুষ্পমগ্ন বাতায়নের আত্মশোভনে। আমাদের বুকে-বুকে সঞ্চারিত হয় কল্পমুকুল। আমেজের  বিলাবলে জমে ঢেউ-বকুল। মেঘগ্রীব ফড়িং। কচুরিপানার চিবুকে লেগে থাকে কলহাস্যের রাজ। নীলমায়া। হৃদিরসের তরুণ তরবারি। নবীনবীণের কামোদ। থরে থরে গোপিনীপদ্মের মৌ। তিলকের অমনিবাস। আমরা প্রাণ পণ, ঢুকে পড়ি কবিতার জেব্রায়। ডোরাকাটা সপ্তপর্ণী। বাতিদান তিরতির। তীরবোঝাই মোমবাতির সানাই। আল্লারবের শরীর। মন্দির ম ম করে মন্দির। রাত জাগায় সাথী হয়, রাতজাগানিয়া ঈশ্বর প্রদত্ত সনেট। অন্ত্যমিলের গদ্যশরীর। সেই বিভায় আমরা আলোকিত, চমকে উঠি। কলমের আগায় ঝলমল করে রেণু-রেণু সরস্বতী। মুখরঝর্নার আলখাল্লা। জীবনানন্দ-আক্রান্ত। জড়িবুটিময় শহর আর গ্রাম আর বর্ণনাতীত গোধূলির জোব্বাঝুলি।

এ এমন এক তান-প্রধান অশ্রুজ সময়। শুনি তাকে, এইসব কবিতা-মুহূর্তগুলিকে, যখন একা থাকি ..গায়ে মাখি এর স্তব স্তুতি যন্ত্রণার দ্যুতি। একার সাথে একা হই, তারপর শুনি নিজেকে পাঠ করা নিজস্ব আবৃত্তি। একাদের জন্যে আঁকা কান্নার আয়াতগুলিকে, ছলকাই পালকের অর্গানে বেজে উঠি। লাটাইয়ের সন্ধিতে ওড়াই ঘুরির শুশ্রূষা, অপটু অববাহিকার কাঁধে মাথা। আমার গড়নেও কেমন চমৎকার বয়ঃসন্ধির অববাহিকা। কাঁদতে কাঁদতে শুনি স্বর্গীয় পলক, চোখের বৃন্দা, জ্বরের ময়ূর। তুমিও মনে রেখো, আজ উৎসব। আজ কবিতার উৎসব। ঝুমকোলতার পরনে আজ কোয়েলিয়া। দোয়েল দেবীর সপ্তকসাজ। আজ কবিতাকে সাজাই এসো। নেকলেসের ধুলো পড়াই তাকে। মনে রেখো, ধুলোর মতো মূল্যবান গহনা হীরেসাম্রাজ্যে আর দুটি নেই।  সবুজ ব্রেসলেট। পালকের চন্দ্রমা। আনন্দের তর্জমা। শুক্লসন্ধ্যার অনুবাদগুলিকে, এসো মুকুট করি। সাজাই কবিতায়। একটার পর একটা পৃথিবী। চাঁদের ওপরস্তরে অন্য আরেকটি চাঁদ। পিঙ্গলার অন্তরে অন্য আকরিকের মৃগশিরা। ভোরের পেয়ালায় নতুন এক চায়ের বাগান।  কবিতা আসলেই নক্ষত্রজগতের উদাসীনালোক, সাতমহল্লার মোহনা-বাড়ি। কবিতাকে গৃহবাসী করবো বলেই তো আমাদের এই দীনহীন বেশ, ভিখারিতে বেজে ওঠা একতারার অট্টালিকা...

 
রত্নদীপা দে ঘোষ