বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

শিখা কর্মকার




শিখা কর্মকার
শোক
গতকাল সারাটাদিন কেবলি বৃষ্টি 
হাজার মাইল জুড়ে ভুট্টাখেতের উপর
আর আজ, কেবলি কালো মেঘ,
টর্নেডোর সাইরেন, সারা শহর জুড়ে
নিরাপদ কোথাও চলে যাবার প্রস্তুতি;
এই অসময়ে হাতে তোমার লেখা শেষ চিঠি,
অভিমানের বাষ্পে আচ্ছন্ন, কি ভাবে লিখলে
সহজে বোঝাতে পারবো বেদনাহীন 
যে আমি বেঁচে থাকবো মাত্র আর দুটি সপ্তাহ ?
তার তিনটে দিন কেটে গেছে অনর্থক গোছগাছে
তবুও চলে যেতে বাধ্য হচ্ছি প্রিয় বন্দর ছেড়ে
এই বিপদে এখানে থাকতে পাবোনা বলে





শিখা কর্মকার
বসন্ত
বসন্তের ঢেউয়ের গন্ধ উড়ে আসছে এই এতটা দুরে
টায়ারের আঁকিবুকি দাগের ভেতরে ঢুকে পড়েছে হলুদ পরাগ;
মুকুলের জড়তা খুলে গায়ে রোদ মাখছে লাল পাতাগুলি,
সাদা লিলিদের গন্ধে বদলে গেছে জীবনের মানচিত্র,
বদলে গেছে ঠোঁটের ভেতরে ছুঁয়ে থাকা সুখের স্বাদ |
রোমাঞ্চে ভরা মুহুর্তে গাড় ফুটে ওঠা তুবড়ির আগুন-ফুলকি
তোমার চোখে চোখ পড়লে সমুদ্রভর্তি মাছ ছলকায় ভেতরে |





শিখা কর্মকার
পকেট কবিতা
মাথার ভেতর ছোট্ট পকেট, সেই পকেটে আমি
ভরেছিলাম মস্ত আকাশ জানেন অন্তর্যামী
বাইরে যখন বৃষ্টি, প্রলয়, বাইরে যখন ঝড়
নীলাঞ্চল আমার আকাশ অতি মনোহর |





শিখা কর্মকার
উড়ে যাবার কথা   
ছড়িয়ে থাকা বীজের ভেতর চুপ করে
শুয়ে থাকে আকাশ ঢাকা বনস্পতি,
কুয়াসার নিঃসঙ্গতার ভেতর ঝিমোয়  চড়ুই ,
ধুসর পাখায় তার এবছরের দুর্যোগের কাহিনী
নিয়ে  একা একা কি যে করে সে সারাদিন !
খরায় বসে কি ভাবে সে  ওইখানটিতে বসে ?
সব ছেড়ে আমার মতই উড়ে যাবার কথা ?





শিখা কর্মকার
জননী জন্মভুমিশ্চ...
শব্দহীনতার ভেতর হেঁটে যাক শুঁয়োপোকা  সজনের কচি সবুজ ডালে | ঘুমোক সদ্য পাড়া ডিমেরা গোলাপের পাতার আড়ালে । ঝুলুক ককুনেরা অনন্ত সময় ধরে মৃত প্রশাখায়, জমে থাকুক যা ছিল বলার তাদের বুকের পরদায়অন্ধ আলো আজ  চুঁইয়ে নামছে ল্যাম্পপোস্টের গা বেয়ে, বুলডোজার এসে পিষে দিচ্ছে একবাগান ফলন্ত বরবটি, সাদা ফুলকপি, কমলা গাজর | পিষে দিচ্ছে গৃহদেবতার বরাদ্দ ঘন দুর্বাঘাস আর সাদা টগরের ঝোপ; তোরঙ্গের ভেতরে রাখা বহু যত্নে ফিরিয়ে আনা পতাকার ভেতরে পিতামহের সাহসিকতার, বীরত্বের মেডাল বাঁধানো ছবিদের | একদল চেনা অচেনা মানুষের ব্যস্ততার ভেতরে একজন শুধু পাথরের মতো অবিচল ।  স্থিরতার ভেতরে স্মৃতির চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে বৃদ্ধা মা | পনের মিনিটের ভেতরে সারা বাড়ির বদলে কাঁচ, কাঠ, ইঁট, সিমেন্টের টুকরো, আর কাগজের দলা | নীরক্ত শবের মত  দুএকটা দেওয়াল দাঁড়িয়ে দেখছে বাড়ির ব্যবচ্ছেদ, যেন লোভের ক্যান্সারে গ্রাস করে নিল আনন্দের, সচ্ছলতার, সহজ জীবনের আলোটুকু; আর কিছু বাকী থাকলো না | অনেকেই বুঝতে পারেনি কখন যে কার ভালবাসা বাহ্যিক হয়ে মুছে গেছে ভেতরের টান, তাই এত সহজে বাইরের লোকেদের সাথে ষড় করে বাড়ির ছেলেরা বিক্রি করে শেষ করে দিতে পারলো গত চারশো বছরের ঐতিহ্য । কেউ জানতে চায়নি বৃদ্ধা মায়ের বুকের ভেতরে এখনো কি সেই ভালবাসামাখা করুন নদীর স্রোত বয় ? কারই বা সেটুকু সময় আছে ? প্রাচীন ভারতবর্ষের মতো নিজের মায়েরও বুকে লোভের উসুল তুলতে গিয়ে ছুরি বসিয়ে হিসেব বুঝে নিতে বড়ই ত্রস্ত বেশ কিছু সুযোগসন্ধানী | এক অসামান্য শব্দহীনতার ভেতরে শোকার্ত আলো এসে পড়ে | কাছাকাছি একটা গাছে পাখীর বাসা থেকে ভেসে আসছে একটা কান্নার শব্দ, মাকে সদ্য সদ্য ভিখিরি বানানোর সার্থকতায় শ্যাম্পেন-বোতল খুলছে তার নাড়ীছেঁড়া ধনেরাআর মায়ের মনে পড়ছে তাদের জন্ম থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত নিজের মুখের গ্রাস তুলে দিয়ে এই মানুষ আকৃতির জীবগুলিকে এক আকাশ স্নেহের আলোয় ভরিয়ে রাখা ....এই জন্যেই, এইসবের জন্যেই, চলে যেতে হবেওদের মুখের দিকে তাকালে কষ্টে ও হতাশায় বুক ভেঙ্গে যাবে বলে, লজ্জায় মুখে ভাত উঠবে না বলে ...|