বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

শাকিলা তুবা




ঢেউগুলো কথা শোনে না
শাকিলা তুবা

ইদানীং একজন বৈজ্ঞানিক তার সমস্ত জ্ঞান ঢেলে দিচ্ছে অন্তরে। যতই বলছি অন্তরে নয় ওসব আমার মগজে ঢালো হে পাগল---সে ততই অদৃশ্য এক বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ নিয়ে ব্যাস্ত। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি তার কলা কৌশল। রিভলভিং চেয়ার থেকে উপচে পড়ছে মহাসাগরের জলরাশি। কুচকাওয়াজ করে কখনো বেহালায় সুরও উঠছে। যত রকমের নৌযান ভিড় করছে জেটিতে, আমার নাকে কেবল কাঁচা মাছের আঁশটে গন্ধ উড়ে আসে। এখান থেকে আর পড়ন্ত বিকেল দেখা যায়না।

স্পটলাইটের কেন্দ্রবিন্দুতে আমার বাঁ চোখ আটক---বৈজ্ঞানিক দেখছে শুধুই চোখ, চোখের ভেতরকার বিন্দুটাতে কালো পাথরের স্থির জল। আমি দেখছি আলো, এক চোখ ধাঁধানো আলো। অন্যচোখে গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্তের একাকার হানিমুন। জাহাজ ভাসে জলে কাঁপতে, কাঁপতে। আমি টের পাই লাইফবোট আর প্যাসেঞ্জারের তাড়াহুড়ো, ক্রুদের ছুটোছুটি। আমার কেবল চাঁদনী রাতের মৃদু কম্পনে দুইদিকে হেলে পড়া বা একটু দুলতে থাকা একটা ডেকে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

লাউডস্পিকারে বাজছে ডজন ডজন বাদ্যযন্ত্রের মিশ্রিত সুর। কেউ নাচে, কেউ মদের ঝোঁকে ফুঁপিয়ে কাঁদে---আমি ভাবছি, দেখো কারিশমা এই বৈজ্ঞানিকের! দিব্যি এক চোখ বন্দী করে গবেষনায় মগ্ন। সটকে পড়বার ধান্দা ছিল অনেক আগেই। যেতে পারছিনা কোথাও। স্পটলাইট ধরে রেখেছে এক চোখ। সে নাকি রক্তচোষা বাদুড়ের হাত থেকে রক্ষা করবে আমায়! আমি তো বন্দী হয়ে আছি এক অবিন্যস্ত পাগলামীর কাছে।

জাহাজ ছেড়ে যাচ্ছে বন্দর। আমি চীৎকার করছি, আমাকে নিয়ে যাও---মসৃন গতিতে পানি কেটে কেটে এগিয়ে যাওয়া জাহাজ থেকে কেউ বলে ওঠে, তুমি পরে এসো, আগে তো মুক্তি কিনে নাও! আর কত পরে? কোথায় কিনতে পাওয়া যায় মুক্তি? পাগল বৈজ্ঞানিক এগিয়ে এসে মুচকি হাসে আর বলে, তোমার সরলতার পুরষ্কার নেবেনা? আমার একচোখ ধাঁধানো আলো। বৈজ্ঞানিক নিঃশব্দে আমার কমলা ঠোঁটে ঠোঁট রাখে আর আমি বর্ষার হানিমুনে দিব্যি ডুবে যেতে থাকি।





আলেয়া
শাকিলা তুবা

সুতীব্র চীৎকারের গোলকধাঁধাঁ পেরিয়ে আমি চিরদিনের ক্রীতদাস দেখে ফেলি দূরের ফসফরাস সঞ্চিত আলোকরেখায় তৈরী আগুনের বল, যা দোল খায় তালগাছের মাথায়। ভৌতিক কান্ড-কারখানা ভেবে যারা কফিনে সেঁধোবার কথা ভাবছে তাদেরকে ছাড়িয়েও দেখছি কমলা রঙ কারো কারো কতই না পছন্দের---

এমন অযুত-লক্ষ দিন থমকে দাঁড়ায় বস্তুবাদীদের ঘিরে
প্লেনের প্রপেলারে তখন ঝিঁ ঝিঁ পোকার কোরাস সুর
আদতে কুয়াশা দখল নিয়েছে মাথাটার
সংশয় আসছে চিন্তায়
বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো মগজ খেলাচ্ছে বিদ্যুৎ
একটু একটু করে জট খুললে পরে
দুই হাতের পাতায় উঠে আসে ইস্কাবনের টেক্কা
নেচে যাচ্ছে আগুনের কমলা বল---পানি আর ফসফরাসের যুথবদ্ধ শক্তি
আমি ইত্যকার ক্রীতদাস এখনো দাঁত কেলিয়ে হাসি
রঙের টেক্কা অচল টাকায় পরিবর্তিত হয়ে গেছে আগেই

আমি শালা দিন দিন আগল ভাঙতে না পেরে গোলকধাঁধাঁর ভেতরেই ঘুরে ঘুরে কানামাছি খেলি অথচ ভূস্বামী ইদানীং চাইছেন এক্কাদোক্কা খেলাতে বিশিষ্ট ভূতকূলের সাথে। পৃথিবী নামক খেলাঘরটা ক্রমশঃ ঝিমিয়ে আসছে। এইবার নিরুদ্দেশ হতে বড়ই সাধ জাগে।





ত্রসরেণু
শাকিলা তুবা

জলীয় বাষ্প মানেই হাওয়া হওয়া জল
তুমি কি আছ? নাকি জলের মতই বাষ্প?
বাতাসে কর্পুর গন্ধ ভাসে
তুমি মিশে গেছ নোনা হাওয়ায়
রেখো গেছো ছাতিমের ভেজা ঘ্রান।

তুমি এখানে ছিলে একদিন
বলোতো, এই তুমিটা কে?
জড় অথবা জীবন্ত?
তুমি জানালায় আটকে পড়া চুলের ফিতে
এক অংশ ভেতরে, বাকীটুকু রাত-শিশিরে ভেজে।

ছায়ার ভেতর তোমার আরেক ছায়া
অন্ধকারে না জ্বলা আলো
তোমায় আর দেখি না
তুমি বাষ্প, বাষ্পই তুমি
সূর্য তাপে নেই হয়েছ কি-না কে জানে!

শুকনো, খটখটে বাতাসে ভাসে না অণুজীব
তুমি অপেক্ষায় আছ বৃষ্টির
আমি পালিয়ে যাচ্ছি মরুভূমির দিকে
খুজঁছি সে জায়গা যেখানে বাষ্প নেই, বৃষ্টি নেই
রেডিওর ঘোষককণ্ঠে ঝড়ের ভুল পূর্বাভাস শুধুই।






হৃদয়ের চারুপাঠ
শাকিলা তুবা

আমিও কিনে নিতে পারি কিঞ্চিৎ শৈলী,
রূপকথাময় জীবন আর আনুমানিক সুন্দর ভবিষ্যৎ
ব্যর্থতার চোরাগুপ্তা হামলা; চিনে নিতে পারি সেও
ভয়াল কিছু সময়ে দিতে পারি নিজেকে বিসর্জন
হৃদয় নির্ভর ঝোলাঝুলিটাই শুধু পারলাম না।

সওদাগরী জাহাজে তুলে দিয়েছিলাম মনোবৃত্তি
দেশ-দেশান্তরের লোকেরা কিনেছিল সবটা সুখী হয়ে
ব্যবসায়ীর ধানের গোলা পেট মোটা হয়ে ছুঁয়েছিল আকাশ
সে আকাশের কার্নিশে হেলান দিয়ে পা দোলাচ্ছিলাম আমিও
দেখছিলাম মনটা ঐ উপর থেকে কেমন খসে পড়ে সাবলীল।

আজকাল বেসিনে ডুবিয়ে হৃদয় ধোয়া শিখেছি
সাবানজলে ভেসে ভেসে লাল হয়েছে মনের চোখ
আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে যতটা শুশ্রূষা দেয়া যায়
সবটা দিয়েই সেবা করে যাচ্ছি পূণঃপৌণিক হারে
হৃদয়টা তবু নিজবৃত্তে শুয়েই এখনো শুধু অলস রোদ পোহায়।






শুক্লাদ্বাদশী
শাকিলা তুবা

একটা দুটো সরীসৃপ ঢুকে যায় মগজে যেমন কখনো কখনো বসরাই গোলাপ পাপড়ি মেলে ওড়ে নির্ভয়ে। আসলে মনের কোন বয়স নেই। উরুসন্ধিতে মেঘ জমুক কি না জমুক জল ঝরছে সর্বক্ষন। এখানে সাঁতার কেটে ইউরোপের টাটকা বরফ, এমনকি আমেরিকার সবজেটে ডলারও কখনো ক্লান্ত হয়নি। শুধু হিসেব কষে কষে শৈশবটা পালিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় প্রৌঢ় ধুতির পিছনে। মন তবু নাকি উড়ে যায় বলাকা হয়ে।

আমাদের দেশে শীতটা তত জাঁকিয়ে পড়ে না তবু অচেনা কিছু বাতাস তুলোর গন্ধ নিয়ে ভরিয়ে রাখে চেতনা। একদিন তাজা তুহিন শ্বেত-শুভ্র ডানা মেলে হালকা হালকা এসে বসবে মাথায় এই আশাতেই চুলগুলো এক সকালে বরফ ছোঁয়। এভাবেই এখানে বিকেল শেষে মায়াবী সাঁঝ নামে। একদিন যে নক্ষত্রপতি জুড়ে ছিল সারা আকাশ আজ তাকে ছেড়ে দিতে হয় সাম্রাজ্য।

আবার নামবে নতুন সকাল, নতুন পূর্নিমা নিয়ে। নাগপঞ্চমীর মেলায় তখন শঙ্খিনী হেসে উঠবে খলখল খল, খলখল খল---নদীর মোহনা পাশ ফিরতে ফিরতে আবার জন্ম দেবে নতুন স্রোতধারা---কলকল কল, কলকল কল। আজ যারা আগাপাশতলা সাপের খোলসে ঢাকা, সেদিন তারা মরা ঘাসে নুয়ে থাকবে আর নতুন ধুতুরার বীজে ভরে উঠবে উঠোনের চারিপাশ।