বৃহস্পতিবার, ২১ জুন, ২০১৮

সম্পাদকের কলমে





আসছে আষাঢ় মাস

কবিতায় আষাঢ় না আষাঢ়ে কবিতা? না কি আষাঢ় মাসের কবিতা? ভাবতে পারেন কেউ কেউ। আষাঢ়ে গল্প শোনা যায়। কিন্তু আষাঢ়ে কবিতা? তাও কি যায় লেখা? কেন যাবে না? সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে আছড়ে পড়া কবিতার প্রাত্যহিক সুনামির বেশিরভাগটাই কি আষাঢ়ে কবিতা নয়? হ্যাঁ এ কথা শুনে অনকেরই গোঁসা হতে পারে নিশ্চয়। কথায় বলে কানা কে কানা বলিও না, খোঁড়াকে খোঁড়া। কিন্তু কে আর সে সব আপ্তবাক্যের ধার ধারে! তাই আষাঢ়ে কবিতার তথ্য কিন্তু মোটেই আষাঢ়ে নয়। কবি বলেছিলেন ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’ তাই কবিতা হোক না হোক আষাঢ়ে কবিতার রমরমা আজকের দিনে। যাঁদের কবিতা ডায়রীর মলাটের আড়াল থেকে বের হতো না কোনদিন, তাদের সত্যিই আজ সুদিন। বন্ধুবর্গের বৃত্তে কবি পরিচিতি অনেক সহজসাধ্য আজকে। সে আষাঢ়ে কবিতাই হোক আর না হোক। এখন যিনি তার্কিক, তিনি যুক্তিতে অবশ্যই শান দিতে পারেন, জনপ্রিয়তাই কবিতার শেষ কথা। পাঠকের মনে আলোড়ন ফেলাই তো কবিতার স্বধর্ম। যে কবিতার সেই দম আছে, থাকবে সেই হলো আসল কবিতা। অর্থাৎ পাঠকের বকলমে বন্ধুবৃত্তই কবিতার শেষ বিচার। যত বেশি লাইক তত বেশি জনপ্রিয়তা। যত বেশি জনপ্রিয়তা তত বড়ো কবি। সে তিনি আষাঢ়ে কবিতাই লিখুন আর যাই লিখুন। জনপ্রিয়তার এই হিড়িকে সকলেই কবি প্রায়। কেউ কেউ আবার বেশ শক্তিশালী কবি তাদের মধ্যে। এখন সেটি কাব্যশক্তি না জনপ্রিয়তার শক্তি বলা মুশকিল। তার্কিকে তর্ক করতেই পারেন, জনপ্রিয়তাই কাব্যশক্তির বড়ো প্রমাণ। অর্থাৎ বন্ধুবৃত্ত আর ভক্তবৃন্দের সম্মিলিত শক্তিই কবি ও কবিতার শেষ কথা। সেখানে আষাঢ়ে কবিতাই বা কি, আর চিরকালীন কবিতাই বা কি। লাইক আর কমেন্টের, বিক্রী আর পুরস্কারের পাল্লা যে দিকে ভারি সেইদিকেই কবিতা।

কবিতার এই যে জনপ্রিয়তার ভরকেন্দ্র, তাই দেখে কেউ যদি আষাঢ়ের মতো মুখ ভার করে বিষণ্ণ বদনে বসে থাকেন তো বুঝতে হবে তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছেনসময়ের পথ এখন উল্টে অন্য দিকে প্রবাহিত। কবিকেও পাবলিক রিলেশানে দক্ষ হয়ে উঠতে হয়। কবিকেও জানতে হয় কখন কবে ক্ষমতার কোন অলিন্দে হামাগুড়ি দিলে সরকারী দরকারী খেতাবগুলিতে নিজের নাম খোদাই করা যায়। তা সে আষাঢ়ে কবিতা লিখেই হোক আর আষাঢ় মাসে বসে কবিতা লিখেই হোক। বাংলা কবিতার হাটে আজকের হট্টরোলে সরকারী খেতাব থেকে উপঢৌকনের নগদ মূল্য শুধু অর্থমূল্যেই নয়। সমাজিক কৌলিন্যেও সে অমূল্য। টিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে কবিসম্মেলনের প্রধান অতিথির চেয়ার, জনগণের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ থেকে কাব্যসংকলনের পাতায় পাতায় স্বশব্দ উপস্থিতি সবই নগদমূল্যেই নির্ধারিত। শুধু রাজসভায় রাজকীর্তনে গলা মেলাতে দক্ষ হলেই হবে। সংখ্যালঘু পাঠকের মনের আষাঢ় তাতে যতই গভীর ঘন হয়ে উঠুক না কেন, আষাঢ়ে কবিয়ালদের তাতে এসে যায় না কিছুই।

বাংলা কবিতার এসব তথ্যে যারা পথ হারিয়ে ফেলবেন, আষাঢ়ের মতো মুখ ভার করে নিজের মধ্যে আরও গুটিয়ে নিতে থাকবেন নিজের কাব্যবোধকে, তাদের জন্য সময় থেমে থাকবে না। তাদের কবিতায় সত্যিই আষাঢ় নামুক আর নাই নামুক, বাংলা কবিতার হাট চৈত্রসেলের মতোই কোলাহল মুখর। পত্রপত্রিকা ওয়েব জার্নাল থেকে সোশ্যাল সাইটের ওয়াল জুড়ে দেওয়াল লিখনটা খুবই সুস্পষ্ট। কবিতার ভিত্তিও বিপণনের দক্ষতায় নোঙর ফেলেছে আজ। সে আষাঢ়ে কবিতাই হোক আর আষাঢ় মাসের কবিতাই হোক। বিপণনে দক্ষতাই কবিখ্যাতির মূলভিত্তি। আর সেই পথ দিয়েই আষাঢ়ে কবিতার আষাঢ় নেমেছে আজ। যে আষাঢ়, পঞ্জিকার নির্ঘন্ট মেনে আসে না। সারা বছরই স্থায়ী রাজত্ব তাহার।

এ সব কিছুই দেখে শুনে, গুনে গেঁথে, ছেঁচে কুটে শব্দের ভিতরে শব্দ বুনে বুনে জীবনের জল সিঞ্চনে কবিতায় আষাঢ় নামাতে পারেন কেউ কেউ। জ্যৈষ্ঠের খরার মতোন সাংস্কৃতিক খরার বুকে সে আষাঢ় জীবনের ভাগীরথী নামাতে পারে যদি, সেই আশায় দিন গুনে গুনে গুনটেনে টেনে চলেন যাঁরা তাঁদের জন্যেই কবিতাউৎসবের আয়োজন ‘আসছে আষাঢ় মাস’এই সংখ্যায় অনেকেরই কবিতা প্রকাশ করা সম্ভব না হওয়ায় আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। সংকলনের উৎকর্ষতার দাবিকে মান্যতা দিতে অনেকেরই কবিতা মনোনীত করা সম্ভব হয় নি। তারপরেও সমগ্র সংকলনের উৎকর্ষতা নিশ্চিত করা সত্যই সাধ্যাতীত সাধনাতবু এই বিষয়ে আমাদের আন্তরিক প্রয়াসটুকুকেই সম্বল করে পাঠকের দরবারে কবিতাউৎসবের আয়োজনে এবারের নিবেদন। এই সংখ্যায় আমরা এ মাসের অতিথি হিসাবে আমাদের মধ্যে পেয়েছি, শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আমাদের বিশ্বাস। কবির সাথে একান্ত আলাপচারিতায়, বাংলা কাব্যসাহিত্যের বর্তমান সময়ের নানান অভিঘাত প্রসঙ্গে কবির সুস্পষ্ট উচ্চারণ সমঁদ্ধ করবে পাঠকবর্গকে।