শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৮

দেলোয়ার হোসেন



দেলোয়ার হোসেন

ধানের কবিতা
 ইছামতি ক্ষেতের ধানসত্ত্বায়
আজ সবুজ কোমল যৌবন দোলা
বউ কথা শোন, নবান্ন এলো বলে..
কী চাস তুই?
শাড়ী, চুড়ি সব হবে, সব
আগে আধপেটা সংসারে হাসিটুকু আন
শরীর হৃদয় ভেঁজে পোলাটারে টান!

 গর্ভবতী ধানের সবুজ আত্মা নিয়ে প্রান্তরের মাঠ
মিলে গেছে দিগন্তের রূপশালী গ্রামের দাঁড়ে;
ফিঙ্গের লোলুপ ল্যাজে চৈতালি বাতাশ
হালুই গীতির নক্সিপিরাণ হয়ে চাষির নেংটিতে নাচে!
নুন-পান্তা-কাঁচা লংকার মিলিত সুখে
রৌদ্রহর তামাটে দুপুর হয় জলাংগীর ঢেউ!
পৃথিবীর এই কোণে মানুষের বাস নেই,
তাই কোনো কোলাহলও নেই
নিশ্চুপ মানবিক স্বপ্নরা ধান আর বোধিবীজ মন্থন করে!
তাই বুঝি, সভ্যতা পিছু ফিরে
আনকোরা পাতার ঘরে হাফ ছেড়ে নেয়!

 চাষির মালকোঁচার শক্ত গিঁটে
পৃথিবীর অনেক লজ্জা ক্রমাগত ছাই আর ধূলো হয়ে যায়ঃ
ভাতের ক্ষিদের তোড়ে শিকেয় তুলে রাখা মানবিক স্বপ্ন স্বাদ
শিকারি বিড়ালের বুভূক্ষু গোঁফ হয়ে কাঁদে! ক্ষেত্রকর তবু
কাঁচি আর কোদালের ভৈরবী ভজনে
শুঁড়ির হাভাতে হাড়িয়ার যৌবন হও, নয় সভ্যতা ধ্বংস হবে!
থোড় ধরা ধানের উত্থিত ধানছড়া আর
কিষানীর আদুল স্তনের সুধাভান্ড
পৃথিবীর সমুদয় সুখ আর সভ্যতার সোনাঝরা মহাকাব্য রচে!

ধানের ছড়ায় ছড়ায় কৃষকের তামাটে স্বপ্নগুলো দোলা দিয়ে যায়!
সুইচোরা ফিঙেরা, ফিকে পালকের উড়াউড়ি আকাশে রেখে
আড় চোখে কৃষকের ঘরগেরস্থালীময় স্বপ্ন মাপে!
স্বপ্নগুলো বড় বেশী ঘুমকাতুরে, যেনো বাঁকা সরিসৃপ খাল
জল ঝেড়ে বুকে কাদা নিয়ে বয়ে গেছে প্রান্তরের শেষে,
বুঝতে পারে না পাখি
মানুষের স্বপ্নের সাথে কৃষকের স্বপ্নের কেনো এতো অমিল?

কে সুখি? কৃষক, না পাখি?
কৃষকের কী পাখির মতো সচ্ছল ডানা আছে?
জানে না ইতর পাখি, তবে ফসলের মৌশুমে দ্যাখে
খড়কুটো আর ধূলোর আস্তরে কৃষকের তামাটে স্বাদ-স্বপ্নকে ঢেকে
ধানগুলো উড়ে উড়ে জড়ো হয় মানুষের গোলায়!

কৃষকের ধানক্ষেতে কবি আজ নিষ্কাম কাকতাড়ুয়া !
হাতে লাঠি, গলায় শামুকের মালা, বড় বেশী হাস্যকর তাই
কাকেরাও লজ্জা পেয়ে বিষ্ঠা ছোড়ে মুখে!
বিব্রতকর সময়, তবুও কলমের শিরদাঁড়ার স্নায়ুতন্তু ভোঁতা!
কৃষকের বুকের জমিন আজ নিষ্ফলা, সুখ-প্রত্যাশাগুলো বর্গীদের
বোগলদাবা হয়ে অহঃরাত্র ঘোরে!
কবিরা কাকতাড়ুয়া, তাই কবিতার আকাল নিয়ে বেঘোরে মরে!
ক্ষেত্রকর তবু ক্ষেতের দুঃখ গুলো ঘুঘুর চঞ্চুর মতো লাঙ্গলে তুলে নেয়
রাত্রির গোপন কোণে, কিষানীর শিথিল বুকে, রুক্ষচুলে দুঃখগুলো ঢালে,
ধানের সবুজ জন্মে কৃষকের পূনর্জন্ম ডেকে আনে ভোরের আকাশ!
তবু জল মাটি আর আগুনের আখ্যান রচে কৃষকের বুক
পৃথিবী এগিয়ে যায় তারপরেও অনেক দূর-
নপুংসক কবি শুধু কলম কামড়ে ধরে সময়কে জ্বালায়!



   



স্বপ্ন

তারপরও কথা হয়।
বেমালুম জীবনের মুখোশ খুলে যায় তারপর !
তারপর নদী হয়, পাহাড় হয়
প্রান্তরের বিস্তৃত ধানক্ষেতে ঝুলে থাকে মটির বাসন !
তারপরও অনেক কথা হয়।
পেট আর গাঁটের গঞ্জনা চলে বহুকাল
ঢেঁকির ক্ষুধার্ত নোটে শব্দ ওঠে দুপ-দাপ তোলপাড়
হাড়ির কালিতে ক্ষুধা ঢাকেনা, ভাগ্য লেপ্টে যায় !
তারপরও কথারা স্বপ্ন হয়
বেমালুম বেভুলো মন ভুলে যায় আর সব
হাতের আঙ্গুলে চেপে ধরি লকলকে লাউডগা শঙ্খচূড়;
মনষার ভোগে সাজাই স্বপ্ন-শালিক !





    
শ্যামল বৃক্ষের স্বপ্ন

বৃক্ষ চিনবো বলে বীজ পুঁতেছি! আদিম মহীরুহ
ডানা ঝাপটে আকাশ ধরে আছে!
কোথায় আকাশ পাবো?
মাটির খুব কাছে নতজানু আদমের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে আজ!
তাকে কোল দাও, বুক দাও
গতরের ওম দাও, উড্ডীন ঘুড়ির লাটাইয়ে সুতো দাও
আকাশ মেপে জীবনের কক্ষপথে হাঁটুক তামাটে কৃষক!
আকাশ খুঁজুক, মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে উর্বর স্বপ্ন আনুক
বীজমন্ত্র পাঠ করুক মোক্ষম বীজধান!
আমাকে ফিরিয়ে দাও
আদিগন্ত ঢেউভাংগা শ্যামল প্রান্তর!





   

রাজপুত্তুর

এই সব লোকালয় লোকাচারে ভরা।
বুদ্ধের পাথুরে ধ্যান
হামনদিস্তায় কাঁপে! শশাঙ্কের শিলালিপি
ক্রমাগত বোধ আর মগজের উপচেপড়া তরলে
শিশুদের ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসির সুরেলা কাব্য হয়!
লোকাচারে অসত্য বলে কিছু নাই।
নিরেট স্থিরতাও নাই।
হোমারের চোখে ব্যসদেব গীতাঞ্জলির বিস্ময় খোঁজে!
কবিতা তাই কবির মগজ পোড়া ছাই, হুঁকায় জলভরা
কল্কে সাজানো নরম হাতের আলাপ, বিসমিল্লার সানাই!
এইসব লোকালয়ে লোকাচারে কবিতা ঈশ্বরবাণী
কবি যেনো রাজপুত্তুর
আকাশপথে ঘোড়ায় চড়ে আসে!

  





একটি নদী
 
একটি নদী
পোষমানা শালিকের মতো
বুকের মাঝে বড় বেশি কুলু কুলু শব্দে বয়ে যায়!
গান গল্পে শোকে দুঃচিন্তায়
যাপিত জীবনের ঝরঝরে বাস্তবতায়
ক্রমশ ক্ষরস্রোতা হয় স্রোতস্বিনী!
রাত্রির শিরদাঁড়া বেয়ে
জুঁইশুভ্র শংখচুড় বিষদাঁতে ছেড়ে নক্ষত্রের শিথিল বসন!
ভুমিষ্ট হয় নাগশিশু
চশমার ঘোলা কাচ
দৃষ্টিরেখায় অবলিলায় গঙ্গা যমুনা খেলে!