শনিবার, ২১ মে, ২০১৬

সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়




পলাতক
সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়
********

বৃষ্টিধোয়া বিকেলে
জন্মান্ধ-কে রামধনু দেখাবে বলে,
ইচ্ছেপাহাড়ের চুড়োয় নিয়ে গিয়ে---
হাত ছেড়ে দিলে অবহেলে,
খেলাচ্ছলে----
তুমি জানতে না,
নৈঋতকোণের মেঘের গর্জন তাকে চিনিয়ে দেবে দিক---
পাহাড়তলির ইউক্যালিপটাস পাতার বিষণ্ণ সৌরভ,
তাকে চিনিয়ে দেবে পথ---
তার গ্রামের মন্দিরের
আরতির ঘন্টাধ্বনি,
তাকে বলে দিয়ে যাবে বাড়ির ঠিকানা--
তুমি জানতে না।

তুমি জানলে না,
জন্মান্ধ নিজের হাত ধরে ধরে,
ঠিক পৌঁছে গিয়েছে তার ঘরে।
শুধু ইচ্ছেপাহাড়ের চুড়োয়
আর রামধনু ওঠেনি কোনদিন---

তুমি জানতেই পারলে না।








এসো, অনিমেষ
সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়।
***************

আমার সঙ্গে একই লগ্নে জন্ম তোমার----
মায়ের জরায়ুফুল থেকে বিচ্ছিন্ন আমি,
কুন্ঠিত দৃষ্টিপাতে দেখেছিলাম পৃথিবীর মুখ---
ঠিক তখনি--------
পাহাড়তলির সবুজ মফস্বল ছেড়ে
অকলুষ কৌতূহলে মুখোমুখি,
তুমি আর রক্তাক্ত নগরী,
বিপ্লবের জাতক তুমি--
অনিমেষ---
এসো।

আমার কুমারী মননে
তোমার প্রথম পদক্ষেপ--
টলোমলো, নিষ্পাপ, মায়াময়,
কিছুটা বিভ্রান্ত---
সেই ছাপ মোছেনি এখনো।
অনিমেষ,
তোমার হাত ধরে হেঁটেছে কৈশোর আমার,
বয়ঃসন্ধি, যৌবন, জরা---
হেঁটেছে কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প-রা,
অর্ধস্ফুট প্রেম, বিরহ, নিশ্চিত বিচ্ছেদ--
সবাই হেঁটেছে অসংকোচে।
কত পা হাঁটলে যেন বন্ধু হওয়া যায়?
আমরা দু'জনে হেঁটে পার হয়ে গেছি,
বিশ্বায়ন, সন্ত্রাস, শতাব্দীর চৌকাঠ-

কিন্তু দেখো, কোথাও যাইনি আমরা।

আংরাভাসার তীরে,
ভুটানের নীল পাহাড়ের গা বেয়ে
সন্ধে নামে--
ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ ফুটপাথে
পুরোনো বইয়ের গন্ধে মেশে
আলুকাবলির মশলার ঘ্রাণ--
শহরতলির ট্রেনে
ঘেমো, হা-ক্লান্ত, হেরে যাওয়া মুখগুলো,
কোলে ময়লা রুমাল পেতে তাস খেলে,
সঙ্গী হয় ন্যাতানো বাদাম---

পৃথিবী এগিয়ে গেছে---
কোথায়, কতদূরে,
কোন কক্ষপথে----
আর তার নাগাল পাব না।
কিন্তু, তুমি আর আমি---
কোথাও যাইনি অনিমেষ---
এসো----
অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত একাকার করে,
বৃত্তাকারে পথ হাঁটি---
মনকেমনের পথ---
এসো।

দেবতা চাইনা,
পুরুষও চাইনি কোনদিন,
মানুষ চেয়েছি শুধু----
আমার জীবনের প্রথম ও শেষ
মানুষ হয়ে--
তুমি এসো, অনিমেষ!!!







তিন নম্বর গেট
সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়।
**************

পৌনে ছ'টার সাইরেন বেজে গেছে
ঘরমুখো ভিড়ে তিন নম্বর গেট
উনুন জ্বলেছে মজদুর কোয়ার্টারে
গরম রুটির গন্ধে আকুল পেট।

কুলিলাইনের ধারে বসে গেছে হাট
হপ্তা পেয়েছে ঘরের মরদ আজ--
গন্ধতেল আর চুমকি বসানো শাড়ি
ভুলিয়েছে বুঝি আটপহরের কাজ!

সপ্তসুরের মাধুর্য্য নিয়ে জাগে,
চেতনা ছাপানো যন্ত্রের ঘর্ঘর---
ধোঁয়ার তুলিতে, আকাশের ক্যানভাসে,
কি ছবি এঁকেছে নিপুণ চিত্রকর।

একদিন ভোরে সাইরেন বাজল না-
ওটা কি ঝোলানো তিন নম্বর গেটে?
''সাদা নোটিসটা মৃত্যুর পরোয়ানা''
শ্রমিক নেতাটি বলেছিল কেটে কেটে।

মালিক লুকোলো আইনের আশ্র্রয়ে
ফিতের গেরোয় সরকারি অনুদান-
ঘোলা গঙ্গার পাড়ময় জঙ্গল,
জংধরা লোহালক্কড় শুধু, চত্বর শুনশান।

খড়ি ওঠা গায়ে, নিরন্ন মুখে হতাশার বল্মীক,
নেভানো চুলা-টা সহ্য হয় না আর-
ছুটে বেরিয়েছে হাত মুঠো করে গঞ্জের রাস্তায়,
করবেই বুঝি হেস্তনেস্ত--এসপার ওসপার।

ব্রিজ ঝমঝম করে ছুটে চলে শহরতলির রেল--
''দু'টাকায় পাঁচ, দু'টাকায় পাঁচ''-- হাঁক ওঠে কামরায়,
ফেরিওয়ালা ফেরে টক ঝাল মিঠে লজেন্স বিক্রি করে---
বিশ্বকর্মা স্বাদ ফেরি করে ভুবনের আঙিনায়।








অলৌকিক বাতিঘর
সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়।
******************

শান্ত সাগরের কোলে
নিরুদ্বেগ নাবিকের প্রসন্নতা নিয়ে
পার হয়ে গেছি
নিরুচ্চার প্রেমের অক্ষরেখা-----
অসতর্ক দিন গেছে
মোহাঞ্জনছায়ায়-----

অকস্মাৎ----
উত্তর সমুদ্র উত্তাল আজ,
প্রতারিত দয়িতার অন্ধ হিংস্রতায়
আছড়ে পড়ছে উদাসীন হিমবাহের বুকে----

ঈশ্বরের নাভিমূল হতে
উৎসারিত অরোরার জ্যোতি
নেই আজ,
পথ দেখাবে বলে----

হারিয়েছি দিক, কূল,
সময়ের ছিন্নসূত্র---
সব, সব-----
হারিয়েছি আমি----
পরশমাণিক খোঁজা ফকিরের মতো
অসহায় চোখ খোঁজে
সপ্তর্ষিমন্ডল----
আমার ফেরার দিশা বলে দেবে
কালপুরুষ।
খুঁজে ফিরি যুদ্ধরিক্ত নিবিড়
হতাশায়।

পৃথিবীর সবটুকু কালি ঢালা
দিগন্তরেখায়,
কিসের আলোকবিন্দু ওটা?
অনুজ্জ্বল শিখা-----
তবু, নিষ্কম্প স্থিরতায়,
ডাকে---
আয়, আয়-----
এই দিকে কূল তোর,
আয়,
ভয় নেই-----
ভাঙা মাস্তুল আর দিকভ্রষ্ট কম্পাসের হিসেব মেলানো--
থাক--- বাকি থাক,
আমি পেয়ে গেছি বাঁচার ঠিকানা।

মেরুসাগরের পারে,
কপালে জাতিস্মর জন্মদাগ নিয়ে,
হাজার বছর ধরে আমার অপেক্ষায়
দাঁড়িয়ে সে---
আমারই মর্মসহচর,
আমার অলৌকিক বাতিঘর।








Stopping by the woods on a snowy evening

By Robert Frost
*****************

Whose woods these are I think I know
His house is in the village though,
He will not see me stopping here
To watch his woods fill up with snow.
My little horse must think it queer,
To stop without a farmhouse near
Between the woods and frozen lake
The darkest evening of the year.
He gives his harness bells a shake,
To ask if there is some mistake
The only other sound's the sweep,
Of easy wind and downy flake.
The woods are lovely, dark and deep,
But I have promises to keep
And miles to go before I sleep
And miles to go before I sleep.

তুষারসাঁঝে ঘরে ফেরার পথে,
গাঁয়ের থেকে অনেক দূরের বন
বনের রাজা আমার গাঁয়েই থাকে---
অজান্তে তার, দাঁড়াই কিছুক্ষণ।

আমার বাহন অবাক চোখে ভাবে,
খামারবাড়ির চিহ্ন কোথাও নেই---
বনের পারে বরফজমা ঝিলে
গহিন আঁধার--- সুয্যি ডোবে যেই,

কন্ঠে বাঁধা ঝুমঝুমি তার নড়ে,
অবোল জীবের সজল চোখের ভাষা
শুধোয় আমায়--''ভুল হয়েছে কিছু?''
বরফি হাওয়ার শনশনে জিজ্ঞাসা।

সবুজ বনের শরীর জোড়া মোহ,
কিন্তু আমায় রাখতে হবে কথা--
অনেকটা পথ পেরিয়ে যেতে হবে,
মেঘের কোলে ঘুমের আসন পাতা।