শনিবার, ২১ মে, ২০১৬

মৌ দাশগূপ্ত



পাঁচ প্রবাস ও আমি
মৌ দাশগূপ্ত

প্রবাস ১

প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রের শিকার আর শিকারী যখন সজীব হয়ে ওঠে,
ধানক্ষেতে ফুরিয়ে যায় সূর্য্যমুখি আলো,
আমার আকাশ জড়ে আদিম অরণ্য ডালপালা মেলে ছায়া ফেলে,
ঠিক তখনই মনে পড়ে আমাদের প্রবাসী জীবন।

সেই কবে আমারও দুমুঠো ভাতা মাপা থাকত
উঠোনে সারি সারি পাতা থালার কোথাও,
কোণে একচিমটি নুন, একফালি লেবু, একগ্লাস জল।
তারপর গরম ভাতের গন্ধ আর ডালের ফোড়নের সুগন্ধ
খুঁজতে খুঁজতে
পায়ে পায়ে ছেড়ে এসেছি মাটির দাওয়া, আলপনা আঁকা চৌকাঠ,
পেয়ারাগাছের বাবুইবাসা, বনতুলসীর ঝোপ, বউমারির ঝিল,
নন্দবাবুর মাঠ,জনাইয়ের ঘাট,বোসেরমোড়
আজ আমি পথঘাট আর ইমারতের ভিতর শিকার করি ,
ভাতের গন্ধে মিশে গেছে আধপোড়া মাংসের দুর্গন্ধ।
আজ আধো অন্ধকারে চোখের জলেই তো নুন,
লেবু নিংড়ানো স্বাদে শুধুই তিক্ততা।
আহা,এখন প্রতীক্ষা শুধু সময়ের, তারপর নতুনদিনের সূর্য্য উঠলেই
দিগন্তব্যাপী প্রাণহীন পাথুরে জমিতে ছড়িয়ে পড়বে মুঠোমুঠো হলুদ,
সামুদ্রিক হাওয়া,ধানের সুবাস আর লেবুফুলের গন্ধে
মুছে যাবে প্রবাসজীবন।








প্রবাস ২

চুম্বন গাঢ় হয়,হলুদপাতার মত উড়ে যায় স্মৃতির মুহূর্তেরা..
সব যাত্রা শেষ হয়,পথ পড়ে থাকে অন্তহীন,
জানেনা পায়ের চিহ্ন,
সব কড়ানাড়া ফুরালেও হাতছানি থেকে যায় অন্তহীন,
জানে না আঙুল।
ঘরের চার দেওয়ালের সীমানা ছাড়ালেই প্রবাসীজীবন
জানে না প্রেম।
তারপর শুধু আঙ্গুলগোনা দিন আর তারাখসা রাত,
আমি দুর থেকেই ভালবাসার নামে আলতো চুম্বন রেখে দিই।
সুর্মার মত কলঙ্ক লেগে থাকে চোখে। আর সুর্মার জ্বালা।
ঠোঁটে ঠোঁট মিললে শুধুই বাসি স্বাদ।
আঙুলে স্পর্শে এক মৃদু কম্পন,হয়ত তোমার-ই হৃদস্পন্দন!








প্রবাস ৩

মূলত দুরত্বই ই বোঝে একা থাকা।
কেমন করে অলকাপুরীর খোঁজে উড়ে যয় মেঘ,
কেমন করে ঈশান থেকে গাঢ় হয়ে আসে মনখারাপের দিন,
না লেখা চিঠি কাগজের নৌকা হয়ে পাড়ি দেয় ফেলে আসা মানুষের খোঁজে।
লবণ সমুদ্রই শুধু জানে কত জলে ভেসে যায়  প্রেমের অঙ্গীকার।
ঢেউ শুধু ঢেউ ওঠে,ঢেউ এর পরে ঢেউ।
একাকী দ্বীপে নাবিকচোখে তাকিয়ে থাকে প্রবাসী ভালবাসা।








প্রবাস ৪

বাঁশি চেনে রাধার বিরহ , মাটি চেনে সীতার অপমান।
আর আমার সপ্তপদী  পরিচয় জানে নিজভূমে পরবাসী জীবন।
নির্ঘুম চোখ জেগে থাকি যৌথ বিজ্ঞাপনের নিয়ন বিলাসে।
সহজ সরলরেখায় আঁকি বিষাদ-বিলাসের ’-এর দ্বৈত ত্রিকোণ।
চন্ডীমঙ্গলের বারোমাস্যা খণ্ড-খন্ড পটচিত্রগুলোকে পাঁচালীগানে লিখে রাখি,
দুআঙুলে ঘষে ঘষে তুলে ফেলি এয়োতির সিঁদুরটিপ,
ঠিকানাবিহীন মেয়েমানুষের  জীবনে আলোছায়া দিনরাতের পিছুটান ফেলে
পায়েপায়ে নদীর ধার ধরে হেঁটে যাই যেখানে সূর্য্য ওঠে।








প্রবাস ৫

প্রতি শীতের পরিযায়ী পাখীদের দেখে ভাবি,
এইবার আমিও পাড়ি জমাবো দীর্ঘ উড়ানপথের,
কুয়াশার আড়ালে মুছে যাবে প্রবাসের ক্লান্ত অবসাদ।
অসুখ সেরে ঝলমলিয়ে উঠবে বিরূপ অনুস্বর বিসর্গ, গ্রহ নক্ষত্র
ভুলে যাবো সেই কবে সে বলেছিল আমায় ভুলে ভালো থেকো।
ইচ্ছেবকের ডানায় ডানায় শেষ হয়ে যাবে পার হয়ে আসাপথ।

ভালবেসে যে পথের একদিন নাম দিয়েছিলাম বিরহ।