বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

এমাসের অতিথি কবি তৈমুর খান



কবিতাউৎসব সাক্ষাৎকার  ১৪২৪
কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত কবিতা আর বাঙালি: বাঙালি আর উৎসব যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে, এই নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশই থাকে না আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি কবিতা পড়তে ভালোবাসি কবিতায় থাকতে ভালোবাসি আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা তাই কবিতা নিয়ে বাঙালির এই উৎসবকেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব,শুধুমাত্র কবিতার জন্যে কবিদের মাসিকপত্র বাংলার জনজীবনে কবিতার এই যে একটা বিপুল প্রভাব এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করে এবং আপনার লেখকসত্ত্বার গড়ে ওঠার পেছনে এই প্রভাব কতটা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে করেন আপনি?

তৈমুর খান: কবিতা উৎসবকে ধন্যবাদ কবিতা উৎসব কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে যুগান্তরকারী পরিবর্তন এনেছে মফস্বলের লেখক কবিরা, যাঁরা তাঁদের প্রথম কবিতাটিও প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে কবিতা উৎসবে প্রতিমাসে অনেকেই ধৈর্য ধরে বসে থাকছে আগে একটা লেখা নিয়ে কোনো লিটিল ম্যাগাজিনের দফতরে গিয়ে হন্যে হয়ে অপেক্ষা করতে হত নতুন কবিতা পড়ারও তেমন সুযোগ ছিল না কবিতা ছাপলে সম্পাদককে পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে বা পুশিং সেল্ করে সাহায্য করতে হত সেটা আর হচ্ছে না যদিও আমি কবিতা উৎসবকে পেলাম অনেকটা পথ অতিক্রম করার পর জীবনে ততদিনে অনেক সূর্য অস্ত হয়ে গেছে
    
বাঙালি জীবনের সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক বহু প্রাচীন রামায়ণ মহাভারতের পাঁচালি থেকে হাতেমতাই, আলিফ লাইলার সুরেলা কাহিনি বাবা সারাদিন কর্মশ্রান্ত থাকার পরও প্রতি সন্ধেবেলা উঠোনে তালাই পেতে লণ্ঠনের আলোয় সুর করে পড়তেন আমি তখন পাঁচ ছয়ের বালক আবার বাবার কাঁধে চেপে গুমানি দেওয়ানের কবিগানের আসরেও যেতাম প্রতিবছরই পালাক্রমে আমাদের গ্রামে বসত গানের আসর সেখানে সত্যপীরের গান, বাউল গান, রামায়ণ, কীর্তন মনসার গান হত রাত জেগে জেগে সেসব আসরে বসে থাকতাম কবিতার জন্ম তো সেখানেই কলকাতায় না জন্ম হলে কিংবা না থাকলে ভালো কবিতা লেখা যায় নাএই কথাটি যে অসার তা টের পেলাম বহু পরে কবিতা উৎসব সকলের জন্য রাস্তা খুলে দিল



কবিতাউৎসব: কবিতা লেখার শুরুর সময় থেকে আজ অব্দি সময় সীমায় কবিতা সম্পর্কে আপনার ধারণার বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়েছে কি? এই প্রসঙ্গেই জানতে চাইব আমাদের বঙ্গসংস্কৃতিতে কবিতা লেখা কতটা হুজুগ সর্বস্ব আর কতটা সাধনা সাপেক্ষ বলে মনে হয় আপনার

তৈমুর খান:  না, কবিতা সম্পর্কে আমার মূল ধারণার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি কবিতা যে প্রাণের তাগিদে আসে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি শখ করে কবি খেতাব লাভের জন্য বা প্রশংসা বা যশের জন্য কবিতা লিখতে আসিনি প্রেমে পড়েও কবিতা লিখতে শিখিনি ছোটবেলায় অনাহারক্লিষ্ট দিনগুলিতে কবিতাই ছিল আমার একমাত্র অবলম্বন কার সঙ্গে কথা বলব? কবিতায় তো নিজের সঙ্গে নিজেরই কথাবার্তা চলত সেদিন যে কবিতা লিখেছিলাম

নির্বাকের পরামর্শে কথা কই
হাঁটতে গিয়ে দেখি পা নেই
এত বৃষ্টি বন্যায় মোক্ষম নদীনালা
নির্ভেজা বসন খুলে নিরালা, শুরু হোক এই মগ্ন খেলা… (তিন টুকরোর পাঠ)

এই নির্বাক এখন নীরবতা বা নিস্তবদ্ধতায় আরও গভীর প্রভাব সঞ্চারী হয়ে উঠেছে পায়ে হাঁটা নয়, মননের তীব্র বর্ণমালাগুলি কবিতায় ছায়া ফেলেছে নদীনালার মোক্ষম বৃষ্টির প্লাবনের মতো আবেগ তখনও ছিল না নির্ভেজা বসন খুলে যে নগ্নতার কথা বলতে চেয়েছিতা ছলনাহীন আত্মসত্যেরই প্রকাশ সমূহ সত্তায় কবিতারই প্রস্তুতি ছিল সেই মগ্ন খেলায় শূন্যতার অভিক্ষেপে আত্মরসায়নের নির্বেদ উচ্চারণে নব্বই দশকেই লিখেছিলামখা শূন্য আমাকে খাকাব্যটি
   
কবিতা লেখা যেমন হুজুগ সর্বস্ব, তেমনি সাধনা সাপেক্ষও হুজুগ দেখা যায় জোর করে কবিতা লেখা, হুবহু নকল করার বা লোক দেখানো কবি হওয়ার ইচ্ছায় এরা কখনোই নিজস্বতা অর্জন করতে পারে না টাকা আছে বলে অনেকেই পত্রিকা বা বই বের করে কিন্তু বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে না এদের শৌখিন মজদুরি একদিন শুকিয়ে যায় কিন্তু যে সাধনার শেকড় অন্তরের অন্তঃস্থলে বিরাজ করে, তাঁরাই পারে ফুল ফোটাতে এঁরাই নিজস্বতা বিসর্জন দেয় না কাল বা মহাকালের উপর সব বিচারের ভার ছেড়ে দিলেও পাঠককে বোকা ভাববার কোনো কারণ নেই বর্তমানে হুজুগটাই বেশি দেখছি পড়াশোনা না করে শুধু মাত্র সাধনাবিহীন কবি হতে চায় অনেকেই



কবিতাউৎসব: কবিতা লেখার প্রেরণায় স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ না কি অভিজ্ঞতাজাত জীবনবোধ সঞ্জাত চেতনার নান্দনিক বিকাশ, কোনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় আপনার কাছে? যদি একটু বিস্তারিত আলোচনা করেন এই বিষয়ে

তৈমুর খান: স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ কোনো ভাবকে উস্কে দেয় ঠিকই, কিন্তু একটা সৃষ্টিকে প্রকৃত শৈল্পিক রূপ দিতে পারে না এর জন্য প্রয়োজন হয় জীবনবোধের ব্যাপ্তি অভিজ্ঞতার নিরন্তর অভিব্যক্তি আবেগকে এই অভিজ্ঞতাই পথ দেখায় আবেগ সকলেরই থাকে এই আবেগের বেশি অংশ প্রকাশিত হয় প্রেমে কিন্তু একে শিল্পের মর্যাদা দিতে পারে চেতনার নান্দনিক বিকাশ আবেগে থাকে অতিকথন, বিবৃতি, উচ্চস্বর, কিন্তু শিল্পে থাকে উপলব্ধির তীক্ষ্ণ বোধ, যা ভাবায়, যা স্তব্ধতা আনে, যার প্রকাশ অনেক সময় ভাষাতেও সম্ভব হয় না রবীন্দ্রনাথস্বপ্নকবিতায় যখন লিখলেন

দূরে বহুদূরে
 স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে
 খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রানদীপারে
মোর পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়ারে

জীবনানন্দ দাশ যখন লিখলেন

হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে

তখন উভয়ের মধ্যে আবেগ অবশ্যই লক্ষ করার মতো কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে তাঁর প্রথমা প্রিয়াকে খুঁজতে স্বপ্নলোকে যেতে হল জীবনানন্দ পৃথিবীর মধ্যেই তাঁর গন্তব্যকে নির্ণীত করলেন একই কথা উভয় কবির বক্তব্য হলেও জীবনানন্দে আবেগ স্তিমিত হল বোধের তীব্রতায় নিত্যঘটিত বর্তমানে তার ব্যাপ্তি প্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথের যে মেলোডিয়াস, জীবনানন্দে তা নেই বললেই চলে প্রকৃত কবিতায় তো এই ভাষাই ব্যবহৃত হয় Rita Dove এই কারণেই বলেছেন “ Poetry is language at its most distilled and most powerful. “
   
টি এস এলিয়টও স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে কবিতা লেখাকে সমর্থন করেননি তিনি বলেছেন “Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion. It is not the expression of personality, but an escape from personality. But, of course, only those who have personality and emotions know what it means to want to escape from these things. “ কথা আমিও বিশ্বাস করি



কবিতাউৎসব: কাব্য সাহিত্যে শ্লীলতা অশ্লীলতার বিতর্ক চিরন্তন একবিংশ শতকের প্রথম পর্যায়ে দাঁড়িয়ে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে আগ্রহী আমরা

তৈমুর খান: কাব্য সাহিত্যে শ্লীলতা অশ্লীলতা বলে কিছু নেই মানুষের প্রবৃত্তিকে অস্বীকার করা যায় না আর আদিম প্রবৃত্তি তো লিবিডোকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টির উৎসমূলেই এর অবস্থান যেহেতু মানুষ সমাজ, রাষ্ট্র পরিবার তৈরি করেছে সেহেতু এগুলিকে মান্যতা দিতেই প্রতিমুহূর্তে নিজেকে দমন করে চলে ধর্মও এই কারণেই সৃষ্টি হয়েছে স্বর্গ নরকের ধারণাও তাই আমি খুব ছোটবেলায়প্রজাপতি “  উপন্যাসটি পড়েছি বড়ো হয়ে বাৎস্যায়ন পড়েছি খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছে আজও সমকামী, বহুকামী, উভকামী মানুষদের চারিপাশে দেখি কিছুই অস্বাভাবিক মনে হয় না সাহিত্যে এর প্রভাব পড়বেই নারী অঙ্গের মধ্যে স্তন মাতৃদ্বার, পরকীয়া যৌনসংসর্গ সবই এসে যায় তবে পর্নগ্রাফি না হয়ে সেগুলি শিল্পসম্মত হওয়া চাই যাতে অশ্লীলতার জন্যই লেখা না হয় স্বাভাবিক ভাবেই যদি তা আসে তো আসুক যেমন স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাসখেলারাম খেলে যাগ্রন্থে দেশভাগ, বিদ্বেষ চরিতার্থ এবং প্রতিশোধের প্রেক্ষিতে উপন্যাসটিতে ধর্ষণ নারীসম্ভোগের ছড়াছড়ি লেখকের দক্ষতায় তা বরং মনস্তাত্ত্বিক হয়ে উঠেছে



কবিতাউৎসব: বাংলা সাহিত্যের আদিগন্ত জুড়ে যে তিনজন কবির ভুমিকা বা প্রভাব সবচেয়ে বেশি, সেই রবীন্দ্রনাথ নজরুল জীবনানন্দের কাব্য ভুবন ছাড়িয়েও বাংলা কাব্যসাহিত্য আজ অনেকদূর বিস্তৃতি লাভ করেছে সেইখানে দাঁড়িয়ে আজকের বাংলা কাব্যসাহিত্য সম্বন্ধে আপনার সামগ্রিক মূল্যায়ণ সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন বিস্তারিত ভাবে

তৈমুর খান:  রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যে যে অবদান রেখেছেন তা স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিপুল ঐশ্বর্য ভাণ্ডার কিন্তু আজকের বাংলা সাহিত্য গতানুগতিক ভাবে তাঁদেরই অনুসারী সাহিত্য নয় বহুমুখী পর্যায়ে স্বয়ং ৠদ্ধ হয়ে উঠেছে আজকের সাহিত্য শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, মণীন্দ্র গুপ্ত, দেবারতি মিত্র, আলোক সরকার, জয় গোস্বামী থেকে বিভাস রায়চৌধুরীর এবং পরবর্তী কবিদের কবিতায় বহুমুখী শৈল্পিক আত্মঅনুরণন শোনা গেল বিভাস রায়চৌধুরী লিখেছেন

ভাষার মগজ ভেসে আসে সকালবেলা
বাহান্ন বা একাত্তর, আমাদের নব্বইয়ের ভাষা
রাতে আমি মরেছি কি মরিনি জানি না,
সকালবেলা ভেসে আসছে অজস্র পিপাসা

কবিতার মননধর্ম এখানেই নিজস্বতা খুঁজে পেল হাংরি আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী না হলেও মননের গূঢ় নির্ণয় থেকে আত্মরতির টানে প্রত্যেক কবিই ব্যক্তিছায়ার সামনে এসে দাঁড়ালেন আধুনিকতার সমষ্টিচেতনা থেকে নিজেকে মুক্ত করে, যুগসংকটের অন্বয় বিদীর্ণ করে আবার সকালের প্রত্যাশায়, পিপাসার তাৎপর্যে জীবনের সংজ্ঞা খুঁজে পেলেন প্রবৃত্তির এই চিরন্তন আকুতিই বাংলা কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য কবিরা আত্মঅন্বেষণে, আত্মস্বরূপ উন্মোচনেই এবং মনুষ্যচেতনার মনন প্রক্রিয়াকে সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্যই নানা রূপক চিত্রকল্পের সাহায্য নিলেন শব্দ তার বাচ্যার্থকে ছাড়িয়ে গেল কোথাও অধুনান্তিক ভাবনার বিচ্যুতির ভেতর দুলে উঠল আত্মগত দ্রুতির ছবি সময়ের প্রেক্ষাপটে, মূল্যবোধহীন অবক্ষয়ের ভাষাও কবিতা হয়ে উঠল জীবনের, সময়ের অনুষঙ্গ নানাভাবে উঠে এল যে নাগরিক জীবনের নৈঃসঙ্গ্য, যুদ্ধ বিধ্বস্ত জীবনের ছবি কবিতায় এতদিন ছিল তা ব্যক্তিসীমানায় ধরা দিল শূন্যতার অভিক্ষেপে স্বপ্নভঙ্গ, দীর্ঘশ্বাস নিজস্ব ছায়াকেই অনুসরণ করল শিল্প শুধু বাইরের মসৃণতায় নয়, বরং কুশ্রিতায় ভেতরের কাঁপুনি আর না বলাকে প্রতিধ্বনিত করতে চাইল স্বাভাবিকভাবেই কবিতার আঙ্গিকেও বদল এল পংক্তিগুলি ভাঙাগড়ার স্রোতে হল প্রবহমান কবিরা কেউ কেউ পেলেন পুনরাধুনিক ভাষা নিজেকে উপলব্ধি করতে করতে যখন আর কিছুই পেলেন না, সবাই দেখলেন নাথিংনেস্ এবং এম্পটিনেস্ তখন আর্থার এরিকসনের ভাষায় তাঁদেরও মনে হল “Illusion is needed to disguise the emptiness within. “ এই অনপনেয় শূন্যতাই কবিদের গ্রাস করল শূন্যের ভেতর কবির তাই অনুভব

যেটুকু বেঁচে আছি তা আমার ছায়া
আমি নই
যেটুকু মরে আছি তাই আমি
যাকে জীবন হিসেবে তোমরা দ্যাখো
ভুল দ্যাখো “(আমি : চিরঞ্জীব বসু)

এঁকে এই আমিরই রূপ আজ বাংলা কবিতায় বিস্তৃত



কবিতাউৎসব: কবি আর কবিতার পাঠক এর মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে সাহিত্য সমালোচকদের ভুমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ আপনার কাছে?

তৈমুর খান: কবিতার পাঠকদের কাছে কবিদের পৌঁছে দিতে সেতুবন্ধনের কাজটি সাহিত্য সমালোচকেরাই করতে পারেন পাঠক অনেক সময়েই নতুনকে স্বাগত জানাতে পারেন না বা তার সীমিত দৌড়ের মধ্যে কবির কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয় না তখন সমালোচকের দ্বারা সেটা সহজেই সম্ভব তবে সমালোচককে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হয় তাঁর গঠনমূলক আলোচনা, নতুনকে উপলব্ধি করা ধারণ করার মানসিক যোগ্যতা থাকা দরকার তাঁর sense of fact বা তথ্যনিষ্ঠা এবং sense of history বা ঐতিহাসিক চেতনার অধিকারী হওয়া উচিত



কবিতাউৎসব: কবি হিসাবে একজন কবির সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্বন্ধে আপনার অভিমত কি? আপনি কি কবিতার সামাজিক দায়বদ্ধতায় আদৌ বিশ্বাসী?

তৈমুর খান: কবির সামাজিক দায়বদ্ধতা কিছুটা তো থেকেই যায় সমাজকে অসাম্প্রদায়িক মানবিক করে তোলা, শোষণ মুক্ত করা, কুসংস্কার দূর করতে যুক্তি বিজ্ঞানের আলোকে জাগ্রত করাও কবির কাজ সমাজ, রাষ্ট্র কোন্ পথে চলেছে তার সঠিক মূল্যায়ন করাও কবির দায়িত্ব দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি তাঁর সমীহ আনুগত্য প্রশ্নাতীত তবে শুধু এই সামাজিক দায় নিয়েই কবিতা লেখা চলে না আত্মঅবস্থানটির সঙ্গে মানবিক অবস্থানটি নির্ণয় করতেই কবিতা কখনো কখনো বিদ্রোহ করতে পারে



কবিতাউৎসব: নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ কবিতার সাহিত্যমূল্যের পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন আপনি না কি রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তি থেকেও মহত্তর কবিতার সৃষ্টি সম্ভব?

তৈমুর খান:  নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শে কবি কখনো আবদ্ধ হতে পারেন না আমি এর ঘোর বিরোধী যেখানেই শোষণ, বঞ্চনা, পীড়ন, সাম্প্রদায়িকতা, অমানবিকতা সেখানেই তিনি রুখে দাঁড়ান কবির সৃষ্টি দৃষ্টি কখনোই একপেশে বা একমুখী মতাদর্শের সমার্থক নয় বরং তিনি সর্বদা মানবিক প্রহরী, স্বাধীনচেতনার রূপকার মহত্তর সৃষ্টি কখনোই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সম্ভব নয়



কবিতাউৎসব: কবি শঙ্খ ঘোষের মতে, ‘সাহিত্যের, সমাজের, আমাদের মূল্যবোধের, আমাদের জীবনযাপনের সামূহিক ক্ষতি করাই এস্টাবলিশমেন্টের কাজ আপনিও কি সেই মতে বিশ্বাসী? আবার আমরাই দেখতে পাই এই এস্টাবলিশমেন্টেই অনেক কবি সাহিত্যিককে খ্যাতির শিখরে পৌঁছিয়ে দেয় একজন সত্যিকারের কবির পক্ষে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কতটা দুরূহ বলে আপনার মনে হয়?

তৈমুর খান: শঙ্খ ঘোষের মতো আমিও এস্টাবলিশমেন্টের বিরোধী সত্যিকারের কবি এস্টাবলিশমেন্ট পছন্দ করেন না এস্টাবলিশমেন্ট অন্বেষা রুদ্ধ করে দিতে পারে মনে অহংকার জন্মায় অহংকারই প্রতিভার মৃত্যু ঘটায় বহু কবিকে আপাত এইপথে সফল মনে হতে পারে, কিন্তু কালের বিচারে তাঁরা হারিয়ে যান জীবনানন্দ দাশের সময়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র কিন্তু আজ তাঁর কথা আমরা ভুলতে বসেছি বিনয় মজুমদার কোনোদিনই এস্টাবলিশমেন্টের মুখ দ্যাখেননি, অথচ তাঁর কথা আমাদের ভাবতে হচ্ছে



কবিতাউৎসব: বাংলা কাব্যসাহিত্যের উপর বিশ্বসাহিত্যের প্রভাব সর্বজনবিদিত আপনার কাব্যচর্চায় এই প্রভাব কতটা সচেতন ভাবে এসেছে? এই প্রসঙ্গেই জানতে চাইব, আপনার খুব প্রিয় বিদেশী কবি কারা?

তৈমুর খান: বিশ্বসাহিত্যের প্রভাব আমার কাব্যচর্চায়ও এসেছে, কিন্তু সচেতনভাবে আমি তা গ্রহণ করেছি একথা বলতে পারব না কবিতার আঙ্গিক নির্মাণ, মেটাফিজিকস্ ভাবনা, মেটাফোরিক অলংকার, জাদু বাস্তবতা, প্রতীক ইমেজের ব্যবহার আমার অজান্তেই নানাভাবে এসেছে এমনকী বিশেষ্য বিশেষণ, ক্রিয়াপদের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তা প্রতিফলিত হয়েছে অতীন্দ্রিয় অনুভূতি বা মহাকালের আমন্ত্রণ বা মানবীয় প্রবৃত্তির অন্ধকারে উঁকি মারার প্রয়াস সবই বিদেশী কবিদের প্রভাবজাত হতে পারে
       
 আমার বিশেষভাবে প্রিয় কবিরা হলেনটি এস এলিয়ট, আলবার্ট কামু, কাফকা, বদলেয়ার, রাঁবো, এজরা পাউন্ড, অ্যালেন গিনসবার্গ প্রমুখ



কবিতাউৎসব: কিন্তু বাংলা কাব্যসাহিত্যের প্রভাব কি বিশ্বসাহিত্যের কোন অংশের উপর দেখা যায় আদৌ? না গেলে কেন?

তৈমুর খান: বাংলা সাহিত্যের প্রভাব অবশ্যই বিশ্বসাহিত্যে পড়ে ভারতীয় ভাবধারা, বাউলতত্ত্ব, আধ্যাত্মিক চেতনার ছায়া তো আগেই পড়েছিল The Waste Land এর শেষ পংক্তিটি ছিলদত্ত, দয়ধ্বম, দাম্যত এছাড়া এলিয়টের The Elder Statesman কাব্যনাট্যে হিন্দু ধর্মের প্রভাব দেখা যায় সেখানে একটা উক্তিতে আছে
“They think in Spanish, but their thoughts are Indian thoughts. “
ভারতীয় জীবনবোধের সহজিয়া ভাবনা, শ্রীরামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের কর্মযোগ, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বচৈতন্য ধারা আজও বিদেশী সাহিত্যিকদের কাছে গৃহীত হয়ে চলেছে টি এস এলিয়ট, ডব্লু বি ইয়েটস, অ্যালেন গিনসবার্গ প্রমুখ সাহিত্যিকগণ ভারতীয় সাহিত্যে প্রভাবিত হয়েছেন সাম্প্রতিককালের কবিতার ক্ষেত্রেও নতুন লিখতে আসা বহু কবিও নিষিক্ত হচ্ছেন



কবিতাউৎসব: একজন প্রকৃত কবির কাছে প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার কতটা মূল্যবান? পুরষ্কারের খ্যাতি কবির প্রতিভাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয় না কি এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে আরও?

তৈমুর খান: প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার প্রকৃত কবির কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় আপাত বিচারে এর অর্থনৈতিক মূল্য কিছুটা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে কোনো প্রতিভার এরকম পুরস্কার হয় না মানুষের ভালোবাসা এবং ভবিষ্যতে কতখানি তিনি জীবিত থাকবেন সেটাই বড়ো পুরস্কার পুরস্কারের খ্যাতি কিছুটা হলেও ক্ষতিকর ব্যক্তিজীবনে অনেক বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে কবিকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিতে পারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রমও হয়



কবিতাউৎসব: আজকের বাংলা কবিতায় ঐতিহ্য আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় সাধন কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার? এই বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের কবিদের ঠিক কি পরামর্শ দিতে আগ্রহী আপনি?

তৈমুর খান: ঐতিহ্যকে অস্বীকার নয়, স্বীকার করেই আধুনিকতাকে আরও পরীক্ষামূলকভাবে গ্রহণ করা উচিত কেননা অতীতের প্লাটফর্মেই দাঁড়াতে হয় আজকের গতিবাদকে অতীতের কাছ থেকেই ভবিষ্যতের শিক্ষা নিতে হয় সুতরাং Tradition এর একটা ব্যাপক অর্থ আছে নিরবচ্ছিন্নতা এর মধ্যেই পাওয়া যায় তা যেমন ইতিহাস, তেমনি অভিজ্ঞতাও এলিয়টড্রাই স্যালভেসেজেবলেছেন

“The past experience revived in the meaning
Is not the experience of one life only
But of many generations,
Time the destroyer is time the preserver.”

মহাকাল অনেককিছুকে ধ্বংস করলেও অনেককিছুই রক্ষা করে ঐতিহ্যের অর্থ শুধু ইতিহাস নয়, সমগ্র সময়কে অখণ্ড এক মহাকালেরই রূপ দেয় তরুণ প্রজন্মকে এই ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে বলব



কবিতাউৎসব: আজকের বাংলা সাহিত্যের দিগন্তে কবি খ্যাতির যে একটি বাজার মূল্য দাঁড়িয়ে গিয়েছে সেটিকে আপনি কিভাবে দেখেন অর্থাৎ এর ভালো মন্দ দুই দিকের বিষয়ে যদি বলেন

তৈমুর খান: কবির বাজার মূল্যের উভয়দিকই আছে কবি যেহেতু মানুষ, সামাজিক মানুষ, সেহেতু তাঁর কাব্যচর্চার মূল্য তো সমাজে থাকা দরকারই তিনিই বা কেন উপেক্ষিত হবেন? তবে এই বাজার মূল্যের জন্য কবিকে প্রতিযোগিতায় না নামাই ভালো কেননা কবির প্রতিভা আর পাঁচটা উগ্র প্রতিযোগিতার মতো নয় বেলেল্লাপনা সেখানে মানায় না যদি তা- হয়, তবে কবিরই অসম্মান



কবিতাউৎসব: কবিতাউৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ পরিশেষে জানতে চাইব বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

তৈমুর খান: বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি যথেষ্ট আশাবাদী চর্চা যেভাবে বিস্তার লাভ করছে, যেহারে পত্রপত্রিকা বের হচ্ছে তাতে নিশ্চিত যে কিছু যুগোত্তীর্ণ সৃষ্টি তো বেরিয়ে আসছেই সবই ঝাঁকের কই নয় মহাকালের দরজায় কম জনই পৌঁছাতে পারে সেই সংখ্যাটাই টিকে থাকবে   আপনাদের সকলকেই আমার আন্তরিক অভিবাদন জানাই কবিতা উৎসব আরও সামর্থ্য উজ্জীবন লাভ করুক একান্তভাবে সকলের কল্যাণ কামনা করছি


তৈনুর খান:  রামরামপুর, শান্তিপাড়া, রামপুরহাট, বীরভূম জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে পিতা ছিলেন দিনমজুর তবু প্রাচীন সাহিত্য, গান ভালো বাসতেন বাংলা সাহিত্যে  মাস্টার ডিগ্রি এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতার উপর  পি এইচ ডি করেছেন কবি বর্তমানে একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহশিক্ষক প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় বিকল্প পত্রিকায় উচ্চ মাধ্যমিক পড়া কালীন ১৯৮৪ তে প্রথম কাব্যকোথায় পা রাখি১৯৯৪ বের করে দৌড় প্রকাশনী তারপর একে একে প্রকাশিত হয় —  বৃষ্টিতরু, খা শূন্য আমাকে খা, আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা, জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর, একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ, প্রত্নচরিত, নির্বাচিত কবিতা ইত্যাদি কবির গদ্যগ্রন্থগুলি হলকবির ভাঁড়ারের চাবি, আত্মসংগ্র, আত্মক্ষরণ, নব্বই দশকের কবি কবিতা ইত্যাদি  প্রাপ্ত পুরস্কার  — কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার, দৌড় সাহিত্য সম্মান এবং সুখচাঁদ সরকার স্মৃতি পুরস্কার