বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ঈশানী রায়চৌধুরী



ভালোবাসার কবিতাগুচ্ছ
পাবলো নেরুদা

ভাষান্তর : ঈশানী রায়চৌধুরী
...............................................

Don’t go far off
খুব বেশি দূরে যেও না তুমি  , একটি দিনের জন্যেও নয় , কারণ
কারণ...কী করে যে বলি তোমায়..একটি দিনও যে কী  ভীষণ দীর্ঘ
আর আমি ..তোমার অপেক্ষায় ..জনশূন্য কোনো রেলওয়ে স্টেশনে
যখন সব ট্রেনগুলো অন্য কোথাও ...নিশ্চিন্ত ঘুমে
আমায় ছেড়ে যেও না , এমনকি এক ঘন্টার জন্যেও নয় , কারণ
তাহলে যে ব্যথার স্ফটিক বিন্দু যত..একসাথে আছড়ে পড়বে ছুটে এসে
যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী খুঁজে বেড়াচ্ছে ভুলে খুলে রাখা কোনো জানালা
আমার হারিয়ে ফেলা হৃদয়ের শ্বাস রুদ্ধ করে দেবে আচমকা হানা দিয়ে
তোমার ছায়াটি যেন আড়াল কোরো না ; নির্জন সমুদ্র সৈকতে
তোমার চোখের পাতা..থিরথিরিয়ে নাই বা কাঁপল দূরে...অস্পষ্ট শূন্যতায়
আমাকে এক মুহূর্তের জন্যেও ছেড়ে যেও না..লক্ষ্মীটি ..
কারণ ওই একটি মুহূর্তেই তুমি এত দূরে চলে যাবে..এত দূরে...
যে আমি  ত্রিভুবন ওলটপালট করে ফেলব 
নিশিতে পাওয়া মানুষ
আর কী যে গোলকধাঁধায় ঘুরে মরা..
আর জানতে চাওয়া...
তুমি আসবে কি? ফিরে ? চলেই গেলে ? আমাকে ছেড়ে ? রেখে  গেলে ? এইভাবে ?
মৃত্যুর অতন্দ্র প্রহরায় ?







I do not love you as if you were brine-rose, topaz
এমন তো নয় যে তোমায় ভালোবেসেছি বুনো গোলাপ ভেবে বা পোখরাজ পাথর
কিংবা  সদ্য তূণীরচ্যুত অগ্নিবাণ
তোমাকে ভালোবেসেছি..যেমন করে কিছু কিছু কৃষ্ণচ্ছায় বস্তুকে ভালোবাসতে জানতে হয়
গোপনে..ছায়াময়তা আর আত্মার সূক্ষ্ম ও প্রায়-অদৃশ্য বিভাজন রেখা স্পর্শ করে

তোমাকে ভালোবাসি সেই গাছটার মতো
নিষ্পত্র , পুষ্পভারহীন
কিন্তু যার মধ্যে আশ্চর্য নি:শব্দ পদসঞ্চারে
এক লুকিয়ে থাকা  ফুলের বর্ণালী
এই চেনা মনমাতাল সুরভি
তোমার ভালবাসার দাক্ষিণ্যপ্রসূত
উঠে আসে ভূমিসুতারূপে
রয়ে যায় আমার গভীর গোপন অন্ধকারে

ভালোবাসি তোমাকে.. কেন, কখন, কোথায়..কিছুই জানি না কিন্তু
অকপট , জটিলতাহীন . অহঙ্কারও ছিল না  কোথাও
ভালোবাসি ..ভালোবাসি ..কারণ এ ছাড়া আমি যে আর অন্য কোনো

বিকল্প জানি না  ; যেখানে  আলাদা করে...আমি নেই, তুমি নেই
আমরা এত কাছাকাছি.,.এত কাছাকাছি ..যে
তোমার হাতটি, যখন আমার বুকে..কী হেলাভ'রে ....এলিয়ে...
তা..আমারই হাত
এত কাছে..যে তোমার  চোখেও ঘুম...
যখন ...
আমিও...







The Queen
তোমাকে আমি "রাণী " বলেই ডাকব
হয়ত কেউ তোমার চেয়ে দীর্ঘাঙ্গী , আরও দীর্ঘাঙ্গী
তোমার চেয়ে শুদ্ধসত্তা , আরও  অনেক বেশি শুদ্ধসত্তা
তোমার চেয়ে প্রিয়দর্শিনী , আরও  অনেকই বেশি প্রিয়দর্শিনী
কিন্তু তুমি যে "রাণী " !
তুমি যখন ওই পথ দিয়ে হেঁটে যাও
কেউ চিনতেই পারে না তোমায়
কেউ দেখতেও পায় না তোমার স্ফটিক মুকুট , কেউ দেখতেই পায় না
তোমায় পায়ের নীচে এলিয়ে থাকা লাল-সোনালি  গালিচা
তুমি দু'পায়ে মাড়িয়ে যাও
অদেখা গালিচা ..
আর তুমি যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াও
আমার সমস্ত শরীর জুড়ে
নদীর কলস্বন , ঝুমঝুমিয়ে ঘন্টা
আকাশ কেঁপে ওঠে
সারা পৃথিবী জুড়ে সুরেলা মন্ত্রোচ্চারণ
শুধু তুমি আর আমি ,শুধু তুমি আর আমি, প্রিয়তমা
শুনতে পাচ্ছ ? আমার কথা







If You Forget Me 
তোমাকে জানানো দরকার
একটা কথা 

একটু বোঝার চেষ্টা করো ..
ধর ,আমার
ঝকঝকে চাঁদের দিকে চোখ ,অথবা  গাছের লালচে শাখায়
মৃদুমন্দ লয়ে শরৎ যখন আমার জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারে
আমি যদি
আগুনের কাছে গিয়ে
চেষ্টা করি ..প্রায় ছুঁতে -না-পারা ছাই ছুঁয়ে দিতে
ওই কুঁকড়ে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া কাঠের খণ্ডটার
জেনো ,এর সব ক'টিই আমাকে নিয়ে যায় তোমার দিকে
মনে হয়,এই যা যা আছে
সুরভি, আলো, ধাতু
সব ছোট ছোট নৌকো
যা ভেসে যায়
ওই সব দ্বীপে,যেখানে তুমি অপেক্ষায়..আমারই জন্য...

অবশ্য এখন
যদি একটু একটু করে আমায় ভালোবাসা বন্ধ করে দাও
আমিও একটু একটু করে তোমায় ভালোবাসা বন্ধ করে দেব

যদি হঠাৎ 
আমাকে ভুলে যাও
আমায় খুঁজো না
কারণ ততদিনে জানবে ,আমিও তোমায় ভুলে গেছি

যদি ভাবো এসবই দীর্ঘসূত্রী উন্মাদনা
এ সব পতাকাদের ঝোড়ো  দামালপনা
আমার জীবনভ'র কতই না এল গেল
আর তুমি ঠিকই করে ফেললে
আমায় একলা রেখে চলে যাবে
মনের তীরে,যেখানে আমার আমি আমূল  প্রোথিত
মনে রেখো , যে ..
সেই দিন
সেই সময়ে
আমি উদ্বাহু হয়ে ঠিক ভেসে যাব
আর আমার অস্তিত্বও ভেসে যাবে
অন্য কোনো মাটির সন্ধানে 

কিন্তু
যদি প্রতিদিন
প্রতি পলে
অনুভব করে থাকো যে তুমি আমারই জন্য
এক অপ্রতিরোধ্য মধুরিমায়
যদি প্রতিদিনই একটি বনজ  কুসুম
তোমার ঠোঁট ছুঁয়ে খুঁজে ফেরে সেই আমাকেই
তাহলে..মানসী
আমার সর্বাঙ্গে দাবানল
কিছুই নিভে যায়নি , কিছুই ভুলে যাইনি
আমার প্রেমের বুভুক্ষা মেটায় তোমার প্রেম
আর যতদিন তুমি বেঁচে থাকবে , ততদিনই   তা থাকবে তোমার  দু'বাহুর আশ্রয়ে
এমনকি আমাকে না ছেড়ে গিয়েও....







Rain
না: , রাণীর চিনতে না পারাই ভালো
তোমার মুখ , এভাবেই যা
অনেক বেশি মিষ্টি , অনুপমা , পুতুলের মুখের চেয়েও , তোমার
চুলের ঢল আমার দু'হাতে ; তোমার মনে পড়ে
ওই ঝাঁপালো গাছটার কথা , যার ফুলগুলো ঝুরুঝুরু হয়ে
তোমার চুলে ? আমার হাতের আঙুলগুলো তো আর
অমন দুধসাদা ফুলের পাপড়ি নয় ; তাকিয়ে দেখো , ওরা যেন অনেকটা ওই শিকড়ের মতো
পাথরের শিকড় , যার ওপর দিয়ে
সরীসৃপ নেমে যায় অবলীলায় ভয় পেও না, আমরা তো অপেক্ষা করব. বৃষ্টির জন্য |
নগ্ন |
বৃষ্টি , যা অঝোরে নেমে আসে সমুদ্রপাখির শরীরে |

কিন্তু যেই না জল রিমঝিম রিমঝিম পাথরের ওপর
তা তো আমাদের ওপরেও !  আমাদের স্নান করিয়ে দেয় নরম আদরে
আর নি:শব্দে নেমে যায় অন্ধকার বেয়ে অনেক নীচে
আগ্নেয়গিরির গহ্বরে |
আর তাই
কক্ষনো যেন জেলেপাড়ায় বা শুঁড়িখানার সামনে দৃশ্যমানা হয়ে এসো  না
তোমার আগুনতপ্ত স্তন রাখো আমার মুখে
আর তোমার চুলের অমানিশা হোক আমার গহীন রাত
ভিজে সুরভির তমসা আমায় আচ্ছন্ন করুক...

জানো , রাতে স্বপ্ন দেখি যেন আমি আর তুমি দুটো গাছ
একসঙ্গে বেড়ে উঠি , শিকড় জড়িয়ে পরস্পর
আর তুমি তো চিনেই নিয়েছ মাটি আর বৃষ্টি ! আমার মুখের মতো চেনা
কারণ আমরাও যে ওই মাটি আর বৃষ্টি দিয়েই গড়া |
কখনো বা
আমার মনে হয় , মৃত্যু এলে  আমরাও ধীরে ধীরে গলে গিয়ে মিশে যাব , চলে যাব অনেক নীচে
গভীরে , ওই পুতুলের পায়ে , আর তাকিয়ে থাকব
সাগরের দিকে , যা আমাদের এখানে এনেছিল সৃষ্টি আর সহবাসের জন্য |

আমার হাত দুটো তো লোহার ছিল না , যখন ওরা তোমাকে ছুঁয়েছিল
অন্য সাগরের জল ওদের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছিল যেন জালিকার মধ্যে দিয়ে |
আর এখন
জল আর পাথর কেমন আঁকড়ে রাখে বীজ আর গোপনকথা |

আর এখন যখন আমারও দু'চোখ ঘুমে
তোমার প্রেমে , নগ্ন
আমার দু'হাত রাখতে দিও তোমার দু'স্তনের বিভাজিকায় , যাতে
সেটি একই কম্পাঙ্কে স্পন্দিত হতে পারে তোমার বৃষ্টিভেজা স্তনবৃন্ত দু' টির সঙ্গে |






I Crave Your Mouth Your Voice, Your Hair
আমার চাই

তোমার  ফুলেল ঠোঁট , তোমার মায়াবী কন্ঠস্বর , তোমার বিদিশার নিশা চুল |
আমি চুপচাপ , উপোসী ; রাস্তায় রাস্তায় ভবঘুরের জীবন  !
রুটিতে কি খিদে মেটে ?
ভোরের আলো আমায় এলোমেলো করে রাখে সারাটা দিন ,
আমি বাজপাখির চোখে খুঁজে ফিরি তোমার ভিজে পায়ের ছাপ |

আমার আগ্রাসী খিদে..তোমার ওই রিনরিনে হাসির জন্য
বুনো ফসলগন্ধী তোমার দু'হাত ..
কী যে বুভুক্ষা আমার.. একবার ...তোমার স্ফটিকস্বচ্ছ  নখের আঁচড়ের জন্য...
তোমার ত্বকে পুরন্ত কাঠবাদামের স্বাদ...

তোমার সারা শরীরে সূর্যের ঝাঁঝালো রোদ ..
আমি ক্ষুধার্ত |
তোমার তিলফুলের মতো নাক
জেগে থাকে, যেন উদ্ধত ডুবোপাহাড়ের চুড়ো ;
চোখের পালকে ভর করে উড়ে যায় রঙের রেণু |

আমি পায়চারী করি ..
অধৈর্য ,
আমার চেতনায় গোধূলির ঘ্রাণ .........

খুঁজেই যাই তোমাকে
আর তোমার লুকিয়ে রাখা উষ্ণ কবুতরী বুক

কৃষ্ণ শ্বাপদের মতো ...
 
একা একা..

উন্মুক্ত , নিষ্প্রাণ আর নিষ্পত্র প্রান্তরে |