রবিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৮

দিশারী মুখোপাধ্যায়





কবিতাউৎসব সাক্ষাৎকার


কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। কবিতা আর বাঙালি: বাঙালি আর উৎসবএ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে, এই নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশই থাকে না। আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি। কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতায় থাকতে ভালোবাসি। আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা। তাই কবিতা নিয়ে বাঙালির এই উৎসবকেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব, শুধুমাত্র কবিতার জন্যে কবিদের মাসিক পত্র। বাংলার জনজীবনে কবিতার এই যে একটা বিপুল প্রভাব এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করে।

দিশারী মুখোপাধ্যায়: কবিতা উৎসবকে অনেক ধন্যবাদ যে তারা আমাকে বিবেচনা করেছেন কে আমাকে বিবেচনা করল আর আমি কাকে, সেটা অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ কারণ তার মধ্য দিয়ে অনেকগুলো বিবেচ্য বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে পরস্পরের মধ্যে একটা সম্পর্ক এবং অনিবার্য রসায়নটুকু অনেক অনুচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর হাজির করে কবিতা উৎসব কবিতার জন্য কাজ করছে কবিতা তাদের ভালবাসা, তাদের জাগরণ ও স্বপ্নবিলাসের সচেতন নির্মাণ ধরে নেওয়াই যায় কবিতা তাদের সংগ্রামের মন্ত্র এবং অস্ত্র এই সব কথাগুলোই একজন নিষ্ঠ কবির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বাঙালি উৎসব প্রিয় জাতি উৎসব তার কর্মসংস্কৃতি, সামাজিক গঠন প্রণালী, ধর্মসংস্কৃতি, ভূপ্রকৃতি ও ইতিহাসকে কেন্দ্র করে এবং এইসকল বিষয়গুলোর ক্রমবিবর্তনকে নিয়ে আগামীদিনের কথা বলে ফলে এই উৎসব কোনো কথার কথা নয় একসময়ে বলা হত বাঙালির বারোমাসে তের পার্বন পরবর্তীকালে বাঙালি জীবনের অভিমুখ ও বৈচিত্র্য অনেক বেড়ে যায় স্বাভাবিকভাবেই তার উৎসবের সংখ্যাও অনেক বেড়ে যায় এবং তার আয়োজনও অনেক আধুনিক সম্মত হয়ে ওঠে যেমন বইকে নিয়ে উৎসব, সাহিত্যকে নিয়ে উৎসব এরপর আসি কবিতার কথায় আমরা কবিতা লিখতে ভালবাসি, পড়তে ভালবাসি এবং কবিতায় থাকতে এই লেখা পড়া এবং কবিতায় থাকা ক্রিয়াপদগুলো আমাদের কষ্টকরে আয়ত্ত করা বা আমাদের উপর আরোপিত নয় আমাদের দেশ (আসলে যা প্রদেশ) আমাদের প্রকৃতি আমাদের পরিজন সবই কবিতার উপকরণ বা সঠিক করে বললে এসবই কবিতা আমরা কবিতার মধ্যে জন্মাই, কবিতারমধ্যে বেড়ে উঠি আমরা কবিতা আত্মস্থ করি জন্মের পর থেকে, মা ঠাকুমাদের মাধ্যমে ফলে এই মাসিক কবিতা উৎসব খুবই সঙ্গত এবং অনিবার্য প্রতি অনুপলে আমি কবিতার অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকি বাংলার জনজীবন কবিতার জল সিঞ্চনে উর্বর এবং ফসল সম্ভবা প্রসঙ্গক্রমে আর একটি কথা বলা জরুরী ছিল যে উৎসব এখন একটি শিল্প বাংলার উৎসবগুলোকে কেন্দ্র করে যেভাবে আর্থিক পরিক্রমা চলে এবং সমাজের বহু মানুষের রুটিরুজির ব্যবস্থা করে তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বাংলার জনজীবন, বাংলার প্রগতিসূচক আমাদের কবিতার আত্মায় অবস্থান করে ফলে আয়োজন করুন আর নাই করুন বাংলায় কবিতা উৎসব ঘটে চলেছে কথা হচ্ছে লিখিত ও পঠিত কবিতার উৎসবের নগর বা রাজধানী কেন্দ্রিকতা ছেড়ে এই উৎসব ছড়িয়ে পড়ছে জেলাস্তরের শহরগুলোতেও এখন এর প্রসার আরো বেড়ে প্রান্তিক অঞ্চলে গ্রামেগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে যার যেমন আর্থিক সঙ্গতি তারা সেইভাবে এর আয়োজন করছেন আর একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে সামাজিক উৎসবগুলোর প্রাঙ্গনেও এখন কবিতা উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে কবিতার ক্ষেত্রে এটা খুবই ইতিবাচক


কবিতাউৎসব: কিন্তু বাঙালির প্রতিদিনের জীবনে কাব্যসাহিত্যের ঐতিহ্য কতটা প্রাসঙ্গিক কতটা হুজুগ সর্বস্ব বলে আপনি মনে করেন? অর্থাৎ জানতে চাইছি জাতি হিসেবে সাহিত্যের সাথে আমাদের আত্মিক যোগ কতটা গভীর। নাকি আসলেই এটি একটি সামাজিক হুজুগ, সামাজিক পরিচিতি লাভের সহজ একটি উপায় হিসাবে।

দিশারী মুখোপাধ্যায়: কাব্যচর্চাকে কখনোই হুজুগ বলা যায় না চর্যাপদ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা কবিতার জার্নিকে কিভাবে হুজুগ বলা যায়হুজুগের জীবনকাল খুব দীর্ঘ হয়না বাংলা কবিতার মনস্কতার সঙ্গে হুজুগ কথাটি যায় না তবে কেউ বা কোনো গোষ্ঠী হয়তো হুজুগে মেতে উঠতে পারেন সাময়িকভাবে সে রকম একটি বা কয়েকটি ঘটনাকে কাব্যচর্চার ঐতিহ্যময় ইতিহাসের সঙ্গে সমার্থক হিসাবে দেখার কোনো যুক্তিই থাকতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করিনা জাতি হিসাবে আমাদের নাড়ির যোগ কবিতার সঙ্গে সামাজিক সমস্ত আচার আচরণই কবিতা আকারে রচিত হত, লিপিবদ্ধ থাকতো, পঠিত হত লক্ষ্মী, নারায়ণ, মনসা এইসব পাঁচালী বা ব্রতকথা সবই কবিতা আশ্রয়ে আছে আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি বিবাহ অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কবিতা রচনা করা হত কবিতা হিসাবে সেগুলোর কোনো মান থাকতো না ঠিকই কিন্তু তারা তাদের কথাগুলো বলার জন্য কবিতাকেই মাধ্যম হিসাবে বেছে নিতেন খনার বচন, যাতে সমাজ, সময়, প্রকৃতি, কৃষি এসব সম্পর্কে মানুষের অভিজ্ঞতার কথা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে যেত ছড়ার আকারে ছড়া কবিতারই একটি ভিন্ন প্রকাশ পুরানো দিনের লোকেরা কথায় কথায় যেসব প্রবাদ প্রবচন ব্যবহারকরতেন তা ছড়ার আকারে একমুখ থেকে অন্য মুখে ছড়িয়ে যেত হ্যাঁ পরবর্তীকালে কবিতা অনেক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তার আঙ্গিক গঠন ও মেধার পরিবর্তন ঘটিয়েছে স্মৃতি ধারণের ক্ষেত্রে, অল্প কথায় বড় বিষয়কে বলার ক্ষেত্রে, অপ্রকাশ্যকে অনির্বচনীয়কে আকারে ইঙ্গিতে ধরার ক্ষেত্রে কবিতার বিকল্প নেই কবিতা চর্চা করে কোনো সামাজিক পরিচিতি পাওয়া যায় কিনা আমি জানি না যদি যায়ও তবে সেটা অবশ্যই পজিটিভ নয় বিশেষত লিটিলমাগ্যাজিনের কবিদের প্রাতিষ্ঠানিক কবি সাহিত্যিকরা কিছুটা সুবিধা পেয়ে থাকেন তবে তা শুধুই কবিতা বা সাহিত্যগুণের জন্য নয় বলাই বাহুল্য কবিতা চর্চা কবির একজাতীয় একটা প্রতিবর্ত ক্রিয়া, যেখানে সচেতন মানুষ-কবির সেরকম কোনোভাবে সক্রিয় থাকার সুযোগ থাকে না সচেতনতা দিয়ে আমরা লেখা, পাঠ, সঙ্গ, সম্পাদনা না করতে পারি কিন্তু কবিতা যাপন বন্ধ করতে পারিনা কবিতা যাপন ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে তাদের আলাদা আলাদা রসায়নের উপর নির্ভর করে এবং তা প্রকৃতিগতভাবে স্বয়ংক্রিয়থাকে তবে আপনার প্রশ্নটি হয়তো একেবারেই অমূলক নয় কেউ কেউ আমরা নিশ্চয়ই বিভ্রান্ত হই এবং এজাতীয় ব্যর্থ চেষ্টা করে থাকি তার ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার কারণ ও উপলক্ষ সবটাই হয়তো কবিতা নয়, বাহ্যিকভাবে কবিতা বা কবিকে দেখা গেলেও অতি সাম্প্রতিক অতীতেও এজাতীয় দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে এবং লক্ষ্য করা গেছে আপাত কবি পরিচিতির আড়ালে আমরা কিরকম অকবিসুলভ আচরণকরেছি তবু বলব এসব সাময়িক বিভ্রান্তিকাটিয়ে আমরা কাব্য-সরস্বতীর প্রতি এবং সেই সঙ্গে নিজেদের প্রতি বিশ্বাস বজায় রেখে নিরন্তর সাধনায় মগ্ন থাকি দেশে এবং পৃথিবীতে এখন চলছে চরম অবক্ষয়, কবি এবং কবিতা এখন একটা সদর্থক ভূমিকা পালন করতে পারে এবং মানুষকে লড়াই করার মানসিকতায় পৌঁছে দিতে পারে দেশে এবং বিদেশেও বহুবার কবিতা মানুষকে দিক নির্দেশ করেছে অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে কবিরা বারবার রুখে দাঁড়িয়েছেন


কবিতাউৎসব:  কাব্যচর্চা বলতে আপনি কি শিল্পসাহিত্যের জন্যেই কাব্যচর্চায় বিশ্বাসী? না কি মনে করেন কবিতারও একটা সামাজিক দায়বদ্ধতাও আছে? আপনার নিজস্ব সাহিত্যচর্চার জীবনেরপ্রেক্ষিতে যদি বিষয়টি একটু আলোচনা করেন। সামাজিক দায়বদ্ধতার নিরিখে,একজন সাহিত্যিকের সমাজসচেতনতা কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার?

দিশারী মুখোপাধ্যায়: একথা আমরা সবাই জানি সাহিত্য চর্চ্চা দুই রকমে হয়ে এসেছে বরাবর সাহিত্যের জন্য সাহিত্য এবং উদ্দেশ্যমূলক সাহিত্য দুটোই সত্য, দুটোই প্রয়োজনীয় কবিতা নিজেকে নিয়ে মগ্ন থেকেছে বিভিন্ন সময়ে নিজের বিষয়, নিজেকে উত্তীর্ণ করার বিষয়, নিজের দৈহিক গঠন, নূতন নূতন শব্দবাক্যের মাধ্যমে নিজেকে যুগোপযোগী করে তোলা; এসব যেমন হয় আবার সঠিক সময়ে উচ্চকিত কণ্ঠস্বরও শোনা যায় এছাড়াও কবিতায় সবসময়ই তার সময়ের কথাই উদ্ধৃত হয় ব্যাক্তিগত প্রেম, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম এমনকি ভগবৎপ্রেমও কবিতারআত্মা, তা উচ্চকিত না হলেও, প্রতিবাদের ভাষায় না হলেও, মানুষকে, সমাজকে দিক নির্দেশ করে এছাড়া আমাদের মুখের ভাষা, আঞ্চলিকভাষা যা সময়ে সময়ে পাল্টায় তার সমসাময়িক দলিল রয়ে যায় কবিতা চর্চার প্রবহমানতার মধ্যে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে কবিতা, আপন ভাষার মধ্যে ভিনভাষার শব্দ আহরণ করে ও সুপ্রয়োগ করে নিজ ভাষার ভূগোল বাড়াতে সাহায্য করে অর্থাৎ নিজ ভাষার শব্দভাণ্ডার বাড়াতে সাহায্য করে কবিতাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যে পরীক্ষা নিরীক্ষামূলক কাজ হয় তা কবিতার ভাষাকে ঋজু করতে, মেদবিহীন করতে সাহায্য করে  আমার নিজের কবি জীবনে আমি ম্যানিফেস্টো ঘোষণা করে বা অনুসরণ করে কবিতা লিখিনি কিন্তু এইজাতীয় কাজকে সমর্থন করি এই রাগী উচ্চারণ, এই বিপ্লবী চিন্তা, ভাঙাগড়া সবই প্রবহমান কবিতা চর্চাকে প্রাসঙ্গিক রাখে কারণ ওইসব আন্দোলনগুলো একএকটা দর্শনকে নিয়ে একটা সময় বৈশিষ্ট্যকে নিয়ে গড়ে ওঠে, যা সময়ের নিজস্ব দাবি থেকেই হয়ে থাকে কোনো একজন বা একাধিক ব্যাক্তির মধ্য দিয়ে এই নতুন ধারার প্রবর্তন হলেও এমন মনে করার কোনো কারণ নেই সময়ের এই চাহিদা ওই একজন ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠীর মনে অকারণ উদ্ভব হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে এই নতুন কাব্যচর্চার শুরু হয় কারণ ওই সময়ের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক বৈশিষ্টগুলোকে ধরার জন্য ওই কাজটির প্রয়োজন থাকে আশির দশকের ভাষা পরিবর্তনের যে কাজ হয়েছিল আমি তার দ্বারা প্রভাবিত ছিলাম কিন্তু কবিতা চর্চায় থেমে যাওয়ার কোনো অবকাশ থাকেনা যেহেতু সমাজ, সময় থেমে থাকেনা কবিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয় নাহলে তিনি একটি বৃত্তে আবর্তন করতে থাকেন যার আক্ষরিক অর্থ হল কবি হিসাবে তিনি মারা যান সুতরাং বোঝা যায় কবি সামাজিক ভাবে এবং সময়ের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন কবিতার শুধুমাত্র অবয়ব নিয়ে যারা কাজ করেন তারাও হয় সচেতনভাবে কিম্বা না জেনে সময়ের দাবিই পুরন করে থাকেন কারণ তার মানসিক গঠনটি সেই সময়ের সমাজ এবং আর্থরাজনৈতিক বৈশিষ্টের দ্বারা নির্মিত থাকে এছাড়াও একটি মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার চারপাশের অনেক মানুষের প্রভাবে থাকে সেইসব মানুষ সমাজেরই অংশ সুতরাং তাদের প্রভাব মানেই সমাজের প্রভাব আর সেই প্রভাবই আমাদের মস্তিস্ককে গঠন করে, নিয়ন্ত্রণ করে আর কবিতার জন্ম হৃদয় হোক বা মেধা, উভয়েরই বাসস্থান কিন্তু মস্তিস্ক বা বৃহৎ অর্থে আমাদের দেহ সুতরাং সমাজ ছাড়া কবিতা নয়, কবিতা ছাড়া সমাজ নয় আমার কথা বলার মাধ্যম আমার কবিতা আমার নিজস্ব হৃদয় জগতের একান্ত ব্যাক্তিগত কথা, সমাজ রাজনীতির প্রেক্ষিতে আমার কথা, প্রকৃতির সঙ্গে আমার জারণবিজারণের কথা সবই আমি কবিতায় বলে থাকি আমি একাডেমিক মানুষ নই, আমি তাত্ত্বিক মানুষ নই আবার এমন নয় যে প্রথাগত শিক্ষা বা অন্যরকমের দীক্ষা বা কোনো তাত্বিক প্রশ্ন আমার মধ্যে কাজ করে না কিন্তু সেসবই আমার নিজের মত করে কোনো উদ্ধৃতি বা তথ্যনির্ভর নয় কবিতাকে অনুধ্যানের মাধ্যমে তার উপর সামাজিক প্রভাবটুকু আবিষ্কার করা যায় অন্যদিকে আমরা এমন কোনো কবিতা রচনা হয়তো করতে পারিনি যা সমাজকে নাড়া দিতে পারে, ক্ষমতাধর কবিরা পারেন, পেরেছেন কিন্তু আমার একটি কবিতা যদি সমাজের একটি বা কয়েকটি মানুষকে নাড়া দেয়, একটি ক্ষেত্রে বা কিছুক্ষণের জন্য স্পর্শ করতে পারে তবে সেটাই আমার কবিতার প্রভাব সমাজের উপর যারা দীর্ঘদিন ধরে কবিতায় যাপন করছেন তাদের অনেকেরই কমবেশী কিছু নবীন কবির সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকে এবং উভয়ে উভয়ের দ্বারা প্রভাবিত হবার ক্ষেত্রে সহাবস্থান করেন প্রবীণ কবি তাঁর ফেলে আসা সময়ের মূল্যবোধ দিয়ে নবীনকে স্পর্শ করতে পারেন এবং নবীন তার সময়ের নতুন চেতনাগুলোকে প্রবীণের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারেন অর্থাৎদুটি বা ততোধিকভিন্ন সময়ের সমাজ চেতনা পরস্পর পরস্পরকে মূল্যায়ন করার সুযোগ পেল এটাকে যুগপৎ কবি বা কবিতার সমাজের উপর প্রভাব আবার সমাজের কবি বা কবিতার উপর প্রভাব বলা যেতে পারে আবার কবিতা প্রত্যক্ষভাবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখিয়েছে তার প্রমাণ ভুরি ভুরি আমাদের বাংলা কবিতাতেই রবীন্দ্রনাথ নজরুল জীবনানন্দের কবিতা সমাজকে যেমন পথ দেখিয়েছে রাজনৈতিক আন্দোলনে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তেমনই সমাজেরও প্রভাব দেখা গেছে অবক্ষয়ী সাহিত্য ও কবিতায়


কবিতাউৎসব: এখন এই সমাজসচেতনতার প্রসঙ্গে একজন সাহিত্যিকের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আবার এই প্রসঙ্গে এইকথাও মনে হয় না কি, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যভুবনকে বৈচিত্রহীন করে তুলতে পারে? এমনকি হারিয়ে যেতে পারে সাহিত্যিক উৎকর্ষতাও?

দিশারী মুখোপাধ্যায়: এর উত্তর আংশিকভাবে আগের উত্তরেই আছে একজন কবি বা সাহিত্যিকের কাছে দেশপ্রেম বা রাজনৈতিক মতাদর্শ আনঅ্যাভয়েডেবল সমাজ সময় রাজনীতি প্রত্যেকটি মানুষকে প্রভাবিত করেই এই আর্থরাজনৈতিক ব্যবস্থায় রুটিরুজির প্রশ্নে প্রত্যেকটি মানুষ নিয়ন্ত্রিত তবে ব্যাক্তি এবং পরিস্থিতি বিশেষে এই প্রভাবের মাত্রা কমবেশি হয় সুতরাং আমার উপর আপতিত প্রভাব আমার লেখায় থাকবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এটা আরোপিত কিনা বা অসৎভাবে প্রক্ষিপ্ত হচ্ছে কিনা বুর্জোয়া ভাবধারার সাহিত্যশিল্পের আধিক্য এবং উৎকর্ষতা যেমন আছে তেমনই সাম্যবাদ সমাজতন্ত্রের আবহে শিল্প সাহিত্যও একটা বিপ্লব ঘটিয়েছিল একসময় যেকোনো সৃষ্টি তা যদি সৎ ভাবে রচিত হয় তবে তার উৎকর্ষতা হারানোর কোনো ভয় থাকে না বলেই মনে হয় লেখকের দর্শনটি যদি পরিস্কার না থাকে অর্থাৎ লেখক যদি বিভ্রান্ত হন বা ভাবের ঘরে চুরি করেন তবে তিনি সফল না হতেই পারেন, সেটাই স্বাভাবিক তবে লেখকের আপাত অসফলতার আরো অন্য অনেক কারণও থাকে অখ্যাত লেখকদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে থাকে তাহলে আমার বিশ্বাসের মূল কথা হল লেখক কবিকে সমাজ সময়ের প্রতি দায়বদ্ধথাকতেই হয় সেটাই লেখার স্বতস্ফুর্ততার লক্ষণ


কবিতাউৎসব:  আবার এই সমাজসচেতনতার ভিত্তি সুদৃঢ় ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে কতটা জরুরী বলে মনে করেন আপনি,এবং কেন? কবি জীবনানন্দ যেমন জোর দিয়েছিলেন সুস্পষ্ট কালচেতনার উপর।

দিশারী মুখোপাধ্যায়: সমাজসচেতনতা আর ইতিহাসবোধ পরস্পরে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ইতিহাস একটি মৃত বিষয় নয় বর্তমানের প্রবহমান স্রোতের নিচে ফল্গুর মত প্রবাহিত হয় ইতিহাস চেতনা ইতিহাসকে এককথায় বলা যায় বর্তমানের নিয়ন্ত্রক ইতিহাসের নানান অসুবিধাকে মানুষ তার ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত অধ্যয়ন দ্বারা জয় করেছে এবং তাদের সেই অভিজ্ঞতা তুলে দিয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে সামগ্রিক মানব সভ্যতা যেমন এইভাবে একটু একটু করে আজকের চেহারায় এসেছে, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাই কারণ সাহিত্যের উপাদান তো মানুষ আর সমাজ তাই এককালে যেমন ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা হত বা এককালের মহাকাব্যগুলো যেমন ধর্মকেন্দ্রিক ছিল আজকের সাহিত্যে তা থাকে না এবং সাহিত্যপাঠের মধ্য দিয়ে আমরা পরবর্তীকালে সাহিত্যটি রচনা কালের সময়, সমাজ, ব্যবসা, রাজনীতি, শিক্ষা, ধর্ম ইত্যাদি সম্পর্কে একটা ধারণা পাই যেমন প্রাচীন সময়ের ইতিহাস রচনা করার সময় যে সমস্ত উপাদান গুলোকে আমরা বিচার বিবেচনার মধ্যেরাখিতাহলো মহাকাব্য, ধর্মমঙ্গলকাব্য, লোককথা, মানুষের মুখে মুখে রচিত ছড়া, শ্লোক ইত্যাদি সাহিত্যের সমাজ মনস্কতা কম বেশি না থাকলে এটা সম্ভব হতনা তবে ইতিহাস সময়ের নিরপেক্ষ দলিল বা তথ্যের ভাণ্ডার অন্যদিকে সাহিত্য লেখকের মন জগতে পাক করা মিষ্টান্ন বিশেষ তাই লেখকের ইতিহাস চেতনা যেমন থাকবে তেমনি কখনোই তা তার মৌলিক রচনা সৃষ্টির অন্তরায় হবে না ইতিহাসের উগ্র উপস্থিতি সাহিত্যের রস সঞ্চারে যেন বাধার কারণ না হয়


কবিতাউৎসব:  এই যে স্বদেশপ্রেম, নিজের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতি দায়বদ্ধতা- এগুলি একজন সাহিত্যিককে আন্তর্জাতিকতার প্রেক্ষিতে কতটা সীমাবদ্ধ করে তোলে বলে মনে করেন আপনি? অর্থাৎ আপনার সাহিত্য তো প্রাথমিক ভাবে এই বাংলার সুর তাল লয়ের মন্থনই। কিন্তু সেই সাহিত্যের পরিমণ্ডলেও কি একজন বিদেশী তৃপ্তি পেতে পারেন যদি না আপনার লেখা আপনার স্বদেশপ্রেম আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উর্ধে উঠতে পারে? বিষয়টিকে আরও একটু অন্যরকম করে মেলে ধরলে বলা যায়, কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছাতে গেলে যে বিশ্ববোধ জরুরী, দেশপ্রেম স্বাজাত্যপ্রীতি কি সেই পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না?

দিশারী মুখোপাধ্যায়: এই প্রযুক্তির যুগে পৃথিবী একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে দেশ বিদেশের সীমাবদ্ধ আবেগ ক্রমশই তার প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে কোথাও মানুষ তার স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হচ্ছে আবার কোথাও সেই বিতাড়িত মানুষ বিদেশে আশ্রয় পাচ্ছে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত মানুষ যে বিদেশে আশ্রয় পাচ্ছে সেই বিদেশ ক্রমে তার স্বদেশে রূপান্তরিত হচ্ছে সম্পূর্ণ পৃথিবী অনেক দিক দিয়েই দুটি ভাগে বিভক্ত দিনরাত্রি, সাদাকালো, ধনীদরিদ্র, নারীপুরুষ, শোষকশোষিত এইভাবে তাই আমার পৃথিবী কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নয় অনেক সময়ই বরং আমার পৃথিবী অন্ধকারের, তাকে আলো দেখাতে হবে আমার পৃথিবী অশিক্ষিত, তাকে শিক্ষা দিতে হবে আমার পৃথিবী অত্যাচারিত, তার পাশে দাঁড়াতে হবে রবীন্দনাথের ঘরেবাইরে উপন্যাসে এই প্রশ্নের উত্তর অনেকটাই দেওয়া আছে উগ্র জাতীয়তা বোধ, উগ্র স্বদেশপ্রীতি মানবিকতার পরিপন্থি আর যেখানে মানবিকতা অবহেলিত তা সাহিত্য হতে পারে না জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দেশ কাল নির্বিশেষে মানুষের ভাবনাচিন্তা, চাওয়া পাওয়া, আনন্দ বিষাদ প্রায় একই তাই প্রকৃত সাহিত্য দেশ এবং ভাষার গন্ডিতে বাধা থাকে না তা মানুষের জন্য আর সব দেশের মানুষ সব সময়ের মানুষ তাকে তার নিজের মনে করে


কবিতাউৎসব: সাম্প্রতিক অন্তর্জাল বিপ্লবে বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভুবন কি বিপুল পরিমাণে বিস্তৃত হয়ে গিয়েছে সেটা আমাদের সকলের চোখের সামনেই ঘটেছে ও ঘটছে। আগে লিটল ম্যাগাজিনের পরিসরের বাইরে অনেকটাই ফাঁকা জায়গা পড়ে থাকতো, যেখানে অনেকেই কবিতা লিখলেও তা চার দেওয়ালের বাইরে আলো দেখতে পেত না। আজ কিন্তু যে কেউই তার কবিতটিকে বিশ্বের দরবারে হাজির করতে পারছে। এই বিষয়টাকে আপনি ঠিক কি ভাবে দেখেন? অনেকেই যদিও বলছেন, এতে কবিতার জাত গিয়েছে চলে। এত বিপুল পরিমাণে অকবিতার স্তুপ জমে উঠছে, যে তার তলায় চাপা পরে যাচ্ছে প্রকৃত কবিতা। এই প্রবণতা বাংলা সাহিত্যের পক্ষে আদৌ কি আশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন আপনি? না কি এটি আসলেই অশনি সংকেত?

দিশারী মুখোপাধ্যায়: অন্তর্জাল বিপ্লব আমাদের সভ্যতায় অনেক সুবিধা যেমন দিয়েছে, দিয়েছে অনেক অসুবিধাও সামাজিক ক্ষেত্রে, আর্থিক লেনদেন ক্ষেত্রে, শিশু মনোজগতে, এবং আমাদের শারীরিক ক্ষেত্রে অন্তর্জাল ও তার প্রয়োগ পদ্ধতি বিশেষভাবে ক্ষতিসাধন করে চলেছে যান্ত্রিক উন্নয়ন বরাবরই মানব সভ্যতাকে যা দিয়েছে কেড়ে নিয়েছে অনেক বেশি এইজাতীয় প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসাবে না গেলে অন্তর্জাল বিপ্লব, বিশেষত বিভিন্ন রকমের সোসাল মিডিয়ায় সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে, একটি বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে ছাপার জগত একসময় ছিল কুক্ষিগত, প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীক পরবর্তীকালে ছাপার জগতে বিপ্লব আসে এবং জেলাস্তরের ছোটো ছোটো শহর গুলোতেও ছাপার কাজ এবং উন্নত মানের ছাপার কাজ সহজপ্রাপ্য হয় ফলে লিটিল ম্যাগজিন গুলোকে ছাপার জন্য কলকাতার মুখাপেক্ষী থাকতে হয় না এবং এইসব অঞ্চলে অনেকেই প্রকাশনার কাজে হাত দেয় অনতিবিলম্বে এইসব প্রকাশকরা বড় বড় বাণিজ্যিক প্রকাশকগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মত প্রডাকশন শুরু করে তবুও লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখকদের সম্পাদকের মর্জির উপর নির্ভর করে থাকতে হয় ছাপার কাজ সহজ হওয়ায় পত্রিকা প্রকাশের কাজ সহজ হলে যে কেউ সম্পাদক হিসাবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেয়ে যায় ফলে সম্পাদনা সব ক্ষেত্রে সুসম্পাদনা হয় না এবং ব্যক্তিগত পরিচয় ও অন্যান্য অনেক বিষয় লেখা প্রকাশের শর্ত হয়ে দাঁড়ায় এর ফলে যে ব্যক্তি শুধুই কবিতায় আছেন, অন্য কোনো যোগ্যতা যার থাকে না, তিনি অপ্রকাশিত থেকে যান অন্যদিকে নতুন কবিকে সামনে আসার জন্য, পাঠকের কাছে আসার জন্য অন্যান্য অনেক অপ্রয়োজনীয় উপায় অবলম্বন করতে হয় কেবলটিভি এবং লোকাল চ্যানেলের আগ্রাসনে লিটিল ম্যাগাজিনগুলো বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্ছিত হয়ে পড়ে ফলে পত্রিকা গুলোর সংকট উপস্থিত হয় আবার ডাকবিভাগ এই পত্রিকাগুলোর বিতরণের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাকে সংকুচিত করে ফলে পত্রিকাগুলো প্রকাশের পর লেখকের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে অনেকক্ষেত্রেই লেখক জানতে পারেন না তার লেখাটি প্রকাশ হল কিনা এবং হলে পাঠকের প্রতিক্রিয়া কী অন্তর্জাল ব্যবস্থা চালু হওয়ার ফলে পত্রিকা ছাপার এবং বিতরণের সমস্যা দূর হয়ে যায় ইম্যাগজিনের প্রয়োগে ছাপার ক্ষেত্রও অনেক বেড়ে যায় ফলে অনেক বেশি সংখ্যক লেখকের অনেক বেশি সংখ্যক লেখা প্রকাশের সুযোগ আসে এরপর ফেসবুকে ব্যক্তিগত ভাবে বা গ্রুপে লেখা পোস্ট করার সুযোগ লেখককে অনেক বেশি স্বাধীনতা দেয় এবং পাঠকের কাছে সরাসরি পৌঁছানোর সুযোগ আসে এটিকে আমি ইতিবাচক বলেই মনে করি মানছি সম্পাদনার অবকাশ না থাকায় নিজের লেখা নিজের ইচ্ছেমত প্রকাশ করার সুযোগে লেখার মান অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল হচ্ছে আবার একই সঙ্গে ভাল লেখাও প্রকাশ হচ্ছে অনেকের ওয়ালে তাত্ক্ষণিকভাবে মত বিনিময়ের সুযোগ বহুগুণ বেড়েছে একেবারে আম পাঠকের কাছে কবিতা কেমন কাম্য তা জানার সুযোগ বেড়েছে আর মুদ্রণ ব্যবস্থায় এবং প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকায় কি খারাপ মানের লেখা ছাপা হয়না? বরং বেশ বেশী রকমেই হয় এবং পাঠককে সেই অপাঠ্য বস্তুকে গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে সংগ্রহ করতে হয়, হয়তো কখনো একটি ভাল লেখা পড়ার সুযোগ পাওয়া যাবে এইকারণে অন্তর্জাল জগতে আমি খারাপ লেখাটি পড়তে বাধ্য নই বা তারজন্য অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহন করতে হয়না অপরদিকে কবিতার পরিসর অনেক বেড়ে গেছে, পড়শিও অনেক বেড়েছে মাঝে মধ্যেই কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি এবং লিটিল ম্যাগাজিনের লেখককে চেঁচামেচি করতে দেখা যায় ফেসবুকের পাতায় গেল গেল রব কবিতার সর্বনাশ হচ্ছে ফেসবুকের কবিদের হাতে প্রতিষ্ঠানের লোকেরা কেন চেঁচায় বুঝা যায় ব্যবসার ক্ষেত্র নষ্ট হলে তারা প্রতিক্রিয়া দেবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু লিটিল ম্যাগাজিনের লোকেরা কেন চিত্কার করে? প্রতিযোগীদের আধিক্যে তাদের গুরুত্ব হ্রাসের আশঙ্কায়? যা অপাঠ্য, যা অকবিতা, যা কূসাহিত্য পাঠক তা কোনোদিন নেয়নি, নেবেও না তা আবর্জনা হিসাবেই বাতিল হবে সময় বলে দেবে কোনটি কবিতা কোনটি নয় সুতরাং অন্তর্জাল কবির ভাল করবে কিন্তু কবিতার ক্ষতি করতে পারবে না বলেই আমার বিশ্বাস একজন প্রতিষ্ঠিত কবির সব কবিতা যেমন ভাল হয় না তেমন একজন অপরিচিত লেখকের বা অদক্ষ লেখকের সব লেখা খারাপ হয় না সুতরাং আখেরে কবিতারই লাভ আর লাভ পাঠকের সে তার পচ্ছন্দমত লেখকের লেখা পড়ার সুযোগ পাচ্ছে আবার নিজের অভিমত সরাসরি লেখককে জানাতে পাড়ছে আমরা বিশ্বাস করি কবির কবিতাটি লেখা এবং পাঠকের পাঠ, এইদুটি ক্রিয়া সম্পন্ন হলে তবেই কবিতাটির সৃষ্টিকর্ম সম্পূর্ণ হয়


কবিতাউৎসব: সমাজজীবনে অস্থিরতা সাহিত্যচর্চার পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন? না কি যে কোন সামাজিক পরিস্থিতিই একজন প্রকৃত সাহিত্যিকের কাছে তার লেখার কার্যকারি উপাদান হয়ে উঠতে পারে। যেমন ধরা যাক ওপার বাংলায় বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, এপারের সত্তরের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের দশক; বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধবাংলার সাহিত্যচর্চার ভুবনটাকে তো বাড়িয়েই দিয়ে গিয়েছে বলা যেতে পারে। তাহলে সাম্প্রতিক মৌলবাদের উত্থান লেখক বুদ্ধিজীবী ধরে ধরে হত্যা,  রাজনীতি ও মৌলবাদের পারস্পরিক আঁতাত; নিরন্তর ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকার বাসনায় বুদ্ধিজীবীদের ক্রমাগত ভোলবদল- এই বিষয়গুলি অতি সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চার পরিসরকে নতুন দিগন্তে পৌঁছিয়ে দিতে পারে কি? বা পারলে সেটা কি বর্তমানে আদৌ হচ্ছে বলে মনে করনে আপনি?

দিশারী মুখোপাধ্যায়: স্থিতাবস্থা কখনই কোনো বিষয়েই ভাল নয় আন্দোলনবিহীন সমাজ বা সময়কে শশ্মানের শান্তির সঙ্গে তুলনা করা হয় ছাপোষা মানুষের পক্ষে গয়ংগচ্ছ, নিস্তরঙ্গ জীবন আপাত ভাল হতেই পারে জীবন কিন্তু স্থিরতার পক্ষে নয়, তার উত্থানপতন আছেই যুগেযুগে অস্থির সমাজজীবন লেখার বিষয় বস্তুর যোগান দেয় জীবনকে নতুনভাবে দেখতে শেখায় তবে সেই আন্দোলনটি রক্তক্ষয়ী বা হিংসাশ্রয়ী হতে হবে এমন মানে নেই বিপ্লব অর্থাৎ পরিবর্তন মূল বিষয় সেই পরিবর্তন মানবিকভাবে হলে তা আগে কাম্য কিন্তু সাধারণত তা হয়না কারণ কায়েমী ক্ষমতা তার অধিকার ছেড়ে নতুনকে মেনে নেয়নি কোনো কালেই বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, তার আগে অবিভক্ত বাংলার বিভাজন, এদেশের ছাত্র আন্দোলন, জনজাতির অধিকার রক্ষার লড়াই সবই সাহিত্যকে বিষয়বস্তু জুগিয়েছে বস্তুনিষ্ঠ সাহিত্যের সম্ভাবনা বেড়েছে এইসব অস্থিরতা সাময়িকভাবে মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে কিন্তু আখেরে মানুষের জীবনে এবং সাহিত্যক্ষেত্রে তা ইতিবাচক হয় সামপ্রদায়িকতাবাদ, মৌলবাদ এসবের সঙ্গে লড়াই করে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তার সভ্যতাকে টিকিয়ে রেখেছে বঙ্গভঙ্গ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সত্তরের ছাত্র আন্দোলন বা নকশালবাদী আন্দোলন সাহিত্যে নতুন নতুন সংযোজন ঘটিয়েছে কী গদ্যসাহিত্যে কী কবিতায় বা গানে ও নাটকে বর্তমান সময় সেই দায়িত্ব পালন করছে কিনা একটা বড় প্রশ্ন আর এইখানেই অন্তর্জাল সাহিত্য বা ফেসবুক সাহিত্যের প্রয়োজনীতা অপরিসীম বর্তমান সময়ের সরকারি বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানই কর্পোরেট দুনিয়ার হাতে, কাজেই সেখানে সময়ের পক্ষে কথা বলা প্রায় অসম্ভব অন্তর্জাল বা ফেসবুকও কর্পোরেট দুনিয়ার হাতে হলেও তাকে সরাসরি গ্রাহকের টাকায় চলতে হয় সুতরাং আমার বক্তব্যটি আমি বলতে না পারলে এইমাধ্যমটি আমার কাছে বাতিল হয়ে যাবে তাতে ব্যবসায়ীর আশু সংকট সরকার ইদানিং এই মাধ্যমটির স্বাধীনতা হরণের বিভিণ্ন ষঢ়যন্ত্র করছে এবং কর্পোরেট দুনিয়া এরমধ্যে আবর্জনা ঢুকিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করারচেষ্টায় সদা নিয়ত আছে তবু সচেতন মানুষ একে তার প্রয়োজনে ব্যবহার করছে কায়েমী এবং মৌলবাদী ক্ষমতার বিরুদ্ধে তাত্ক্ষণিকভাবে গর্জে ওঠার জন্য এই মাধ্যম এখন অনন্য কবি সাহিত্যিকরা তাদের প্রতিবাদ সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে দিতে পারছেন প্রতিবাদী কবিতাটি সঙ্গে প্রকাশ হবার অবকাশ থাকছে মুদ্রণ ব্যবস্থায় সেই প্রতিবাদী লেখাটি প্রকাশ হতে হতে তার প্রাসঙ্গিকতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলে প্রতিদিন ফেসবুকের পাতায় নজর রাখলে তার হাজারো নমুনা পাওয়া যাচ্ছে তার অনেকটাই যথাযথ সাহিত্যের পর্যায়ে না পড়লেও কোথাও না কোথাও কেউ উল্লেখযোগ্য লেখাটি লিখছেন


কবিতাউৎসব: আবার ধরা যাক এই সব নানান জটিলতা থেকে মুক্তি পেতেই একজন সাহিত্যিক বিশুদ্ধ কবিতার কাছে আশ্রয় পেতে ছুটলেন। যেখানে রাজনীতি নেই, সামাজিক অস্থিরতার দহন নেই, আছে শুধু ছন্দসুরের অনুপম যুগলবন্দী। জীবনের জটিল প্রশ্নগুলি এড়িয়ে গিয়ে,  কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে ছোটালেন তাঁর বিশ্বস্ত কলম। কবিতা তো মূলত কল্পনারই ভাষিক উদ্ভাসন। কিন্তু সেই পলায়নবাদী কবির কাছে পাঠকের আশ্রয় কি জুটবে? কবির কলম পাঠকের কাছে কতটা বিশ্বস্ত থাকবে সেক্ষেত্রে বলে মনে করেন?

দিশারী মুখোপাধ্যায়: বিশুদ্ধ কবিতায় সমাজ সময়ের ছাপ থাকে না আমি বিশ্বাস করিনা দহন বিনে সৃষ্টি অসম্ভব তবে পরীক্ষানিরীক্ষার তলায় সেই কথাগুলো সুপ্ত থাকে, প্রকট থাকেনা হাংরি আন্দোলন কি তার সময়ের কথা বলেনি? সময়ের কথা বলার জন্যই সেই কথনভঙ্গির উদ্ভব হয় দশকওয়ারী কবি ও কবিতাকে চর্চা করার উদ্দেশ্যই হল সময়ের কণ্ঠস্বরকে আবিষ্কার করা তবে কবিতা পাঠককে মাথায় রাখতে হবে কবিতা রচনা করার সময় কোনো কবি কবিতার আকারে কিছু বলেন তা সে অর্থে ততটা হয়তো কবিতা সুলভ হল না আবার কোনো কবি কবিতা রচনার সময় বক্তব্যকে প্রচ্ছন্ন রেখে নির্মাণের দিকে অধিক গুরূত্ব দিলেন গৌরীলংকেশ হত্যার সরাসরি প্রতিবাদ করে কবিতা লিখলে তা বক্তব্যধর্মী হওয়াই স্বাভাবিক অন্য কোথাও একটি নির্মাণধর্মী কবিতায় প্রচ্ছন্নভাবে গৌরির উপস্থিতিও টের পাওয়া যেতে পারে বস্তু বাদ দিয়ে কল্পনা হয় না যা আমি দেখিনি তার কল্পনা সম্ভব নয় বাস্তবতা এক্সটেনশন করে কল্পনার দিকে যাওয়া যায় মাত্র ফলে কল্পনা যেমনই হোক তাতে আমাদের পাওয়া না-পাওয়া, চাওয়া না-চাওয়া, বলা না-বলা, দেখা না-দেখা ওতপ্রোত আর কবিকে পাঠকের কাছেতো বিশ্বস্ত থাকতেই হয়, তার আগে স্বচ্ছ থাকতে হয় নিজেরকাছে


কবিতাউৎসব:  সাহিত্যে শ্লীলতা ও অশ্লীলতার তর্ক বহুদিনের। আজও সে বিতর্কের অবসান হয় নি বলা যায়। নিজের লেখা সম্পর্কে অনেক সাহিত্যিককেই অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হতে হয়েছে তার সময়ে বিভিন্ন সমালোচকের কাছে। আপনার সাহিত্যচর্চার জীবনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে এই বিষয়ে আপনার অভিমতে যদি সমৃদ্ধ করেন কবিতাউৎসবের পাঠকবৃন্দকে।

দিশারী মুখোপাধ্যায়:  শ্লীলতা অশ্লীলতা বিতর্কটি বড়ই বিতর্কিত কোনো শব্দ বা চিত্রকল্প কখনো অশ্লীল হতে পারেনা বলেই আমার বিশ্বাস উদ্দেশ্যটি অশ্লীল হতে পারে একটিও তথাকথিত অশ্লীল শব্দ ব্যবহার না করেও অশ্লীল ইঙ্গিত করা যেতে পারে আবার তথাকথিত সমাজের বিকৃতিকে তুলে ধরার দরকার হলে তার যা প্রয়োজন তা করাই যুক্তিযুক্ত তবে কবিতা রচনার ক্ষেত্রে ইদানিং কারো কারো, হয়তো স্মার্টনেশ আয়ত্ত করার জন্য, ব্যক্তিগত শারীরিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বহুল প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে অচরিতার্থ কামনা বাসনার লিখিত প্রয়াস দেখা যাচ্ছে শরীর বাদ দিয়ে আমাদের কোনো অস্তিত্ব নেই কিন্তু আমাদের সমস্ত ভাবনার কেন্দ্রীকতা যদি বারবার যৌনতা বিষয়ক হয় তবে তাকে হয়তো যৌনতা প্রবণ ব্যক্তি বলা যায়  একদিনের ঘটনা বলি আমারএক কবিবন্ধু অশোকতরুর সঙ্গে একদিন শুশুনিয়া যাচ্ছিলাম শাল জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সেখানে আমরা উপলব্ধি করি সেই সময়টুকু আমরা নাগরিকতা থেকে বহুযোজন দূরে গাছেরাও বংশবিস্তার করে কিন্তু কোথাও সেখানে যৌনতার নাম গন্ধ নেই কবিতার মধ্যেও আমাদের প্রেম অপ্রেম যদি তেমন ভাবে প্রকাশিত হয় তার সব কথাটুকু বলে তবে হয়তো আর যৌন অঙ্গের বিবরণ দরকার হয়না তবু আমি মনে করি এবিষয়ে লেখক শিল্পীর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা বাঞ্ছনীয় আমি ব্যক্তিগতভাবে যৌনতা এমনভাবে ব্যক্ত করতে পচ্ছন্দ করি যাতে পাঠকের স্বাধীনতা থাকে তার নিজের মত করে কবিতাটিকে আবিস্কার করার


কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখণ্ডিত বাংলায় কলকাতা কেন্দ্রিক ও ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার দুটি ভিন্ন স্রোতের মধ্যে কি ভাবে সামঞ্জস্য বিধান করবেন বাংলাসাহিত্যের একজন পাঠক? ৪৭এর দেশভাগ বাংলাসাহিত্যের দিগন্তকে কতটা প্রসারিত করেছে বলে আপনার ধারণা। এই যে কাঁটাতারের দুইপারে ধুটি ভিন্ন ঘরানার বাংলাসাহিত্যের দিগন্ত দাঁড়িয়ে গেল; এইটি আপনি কি ভাবে দেখতে চান?

দিশারী মুখোপাধ্যায়: কলকাতা কেন্দ্রিক এবং ঢাকা কেন্দ্রিকতার সামঞ্জস্য বিধানের একটা চেষ্টা চলছে উভয় দেশের সরকারি স্তরে এবং বেসরকারি ও প্রান্তিক উদ্যোগে সামঞ্জস্য কতটুকু হচ্ছে সেটা বিচার্য বিষয় অনেক ক্ষেত্রেই তথ্য আদান প্রদানে ভুল থাকার জন্য সঠিক প্রতিনিধিত্ব না থাকার জন্য ভুল বার্তা গিয়ে পৌঁছায় ফলে উভয় দেশের সাহিত্যের ভাবনা চিন্তা ও কাজকর্মের সম্পর্কে উভয় দেশই অন্ধকারে থেকে যায় এবং উভয়েই উভয়ের কাছ থেকে উপকৃত হয়না কিন্তু আমি এইবঙ্গের ক্ষেত্রে বলতে পারি, কলকাতার সাহিত্য চর্চার সঙ্গে জেলাগুলোর তথা গ্রামবাংলার সাহিত্য চর্চার সামঞ্জস্যে ফাঁক থেকে যায় এখানে আমাদের দশকের পর দশক ধরে কলকাতা কেন্দ্রীকতার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে আসতে হচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ছবিটা কেমন আমি জানিনা  ৪৭এর দেশ ভাগ সাহিত্যের উপাদান বাড়িয়েছিল অনেক দেশভাগ এবং তদজনিত কারনে মানুষের জীবনে যে বিপর্যয় ঘটেছিল তা মানুষকে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করেছিল মানুষের জীবনই সাহিত্যের উপাদান এবং সেই মনুষ্যজীবনে যত বৈচিত্র্য আসে সাহিত্য রচনায় তা ইতিবাচক হয় কিন্তু এই ইতিবাচকতা সাময়িক আখেরে দেশ ভাগ বাঙালি জাতি বাংলা ভাষার ক্ষতি করেছে বঙ্গভঙ্গ না হলে বাংলাভাষা আজ ভারত উপমহাদেশের মত একটি বিশাল দেশের জাতীয় ভাষা হতে পারতো, অন্তত সরকারি উপেক্ষার শিকার হতে হত না অপরদিকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের ফলে সেদেশের জাতীয়ভাষা বাংলা সেখানকার সরকার সে ভাষার উন্নয়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা করবেন এটাই স্বাভাবিক আমি বলতে চাইছি এই দুই বাংলার মিলিত প্রচেষ্টা অনেকবেশি ফলপ্রসূ হত আবার স্থানিকতার বৈচিত্র্য জনিত কারণে বিভিন্ন ঘরানা তাদের ফসল ফলনেও সক্ষম থাকত ওপার বাংলায় শুনি বাংলা নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে এ বাংলায় বাংলাতো প্রায় বর্জিত ইংলিশ মিডিয়াম পড়াশুনার চল আর হিন্দির প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষপাতিত্বের কারণে নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষাটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে মানুষের মুখের ভাষা কাজেরভাষাই যেখানে অস্তিত্বের সংকটের মুখে সেখানে সেই ভাষায় সাহিত্য রচনার প্রাসঙ্গিকতাও আর থাকে না তাই বোধহয় কিছুদিন আগে একটি পত্রিকার সম্পাদককে বলতে শুনি নবীন কবিরা যত খারাপ লেখা হয় হোক, প্রকাশের জন্য পাঠান যে বাঙালি প্রজন্ম বাংলা লেখা পড়া কিছুই জানেনা তাদের বাংলা লেখা পড়ায় ফিরিয়ে আনাই একটা চ্যালেঞ্জ তাই সব ভুলত্রুটির সঙ্গে আপোষ করেও এই পদক্ষেপ হয়তো এপাড় ওপাড় নিয়ে চিন্তা করিনা বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাংলা গানকে যারা টিকিয়ে রাখবে আমরা নিশ্চিতভাবে তাদের সঙ্গে থাকবো


কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখণ্ডিত জাতিসত্ত্বায় সাম্প্রদায়িকতার যে চোরাস্রোত নিরন্তর বহমান,যাকে পুঁজি করে ইঙ্গমার্কীণ মহাশক্তি ও তাদের বঙ্গজ সহসাথীরা ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনীতিতে সদাসক্রিয় থাকে; নেট বিপ্লবের দৌলতে সুদূর ভবিষ্যতে সেই সাম্প্রদায়িকতার চোরাস্রোত থেকে কি গোটা জাতিকে মুক্ত করতে পারবো আমরা? আপনার অভিমত! আর সেই কাজে সাহিত্যের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে আপনি মনে করেন!

দিশারী মুখোপাধ্যায়: উগ্র জাতীয়তাবোধ, সাম্প্রদায়িকতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে মানুষ লড়াই করে এসেছে, সামনের দিনেও করবে সাময়িকভাবে কখনো কখনো অন্যায়ের জয় হয় কিন্তু সেটা সাময়িকই মানুষের শুভ বুদ্ধি মানুষকে পথ দেখায় কবি শিল্পীরাও সাধারণ মানুষ দুষ্ট শক্তির অশুভ কাজে নজরানার প্রলোভনে তারাও হয়তো অনেকেই বিভ্রান্ত হয়, কিন্তু সবাই নয় রাজার পোশাক নেই বলার জন্য কোথাও কেউ একজন বা কয়েকজন থাকে অখ্যাতির আড়ালে তাই সাহিত্য শিল্প তার দায়িত্ব যথাসময়ে পালন করবেই


কবিতাউৎসব: এবার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অভিমুখে এসে আপনার নিজের লেখালেখির বিষয়ে যদি জানতে চাই, আপনার পাঠকের কাছে ঠিক কি ভাবে পৌঁছাতে প্রয়াসী আপনি?

দিশারী মুখোপাধ্যায়: দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর কবিতা লিখছি অল্প বয়সের চপলতায় প্রথম জীবনে কিছুদিন হয়তো পাঠকের কাছে পৌঁছবার আকুতির সঙ্গে লড়াই করেছি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছি নিজেও একাধিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছি পরে বাংলা কবিতার সঙ্গে যত পরিচয় হয়েছে, বাংলা কবিতার বনস্পতিদের কথা যত শুনেছি, যত বেশি করে কবিতার প্রেমে পড়েছি তত সেই আত্মপ্রচারের ইচ্ছা দুর্বল হয়েছে প্রকাশের থেকে লিখতে বেশি ভালবাসি নিজে লেখার থেকেও নতুন কেউ লিখছে শুনলে বেশি ভাললাগে  কেউ, কোনো বন্ধু, কোনো সম্পাদক লেখা চাইলে দিই মনোনীত হলে ভাললাগে অমনোনীত হলে বুঝি ঠিকমত লিখতে পারি নি আরো ভাল লেখার চেষ্টা করি প্রায় প্রতিদিন কবিতা লিখি আর পড়ি কিন্তু মনে রাখতে পারিনা যা লিখি ফেসবুকে বন্ধুদের মতামত নেবার জন্য পোস্ট করি ঠিক লিখতে যদি কোনোদিন পারি পাঠক ঠিক খুঁজে নেবেন আমাকে পাঠক পড়েন এবং লক্ষ্য রাখেন তবে ব্যবসায়ীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা এখনো করিনি


কবিতাউৎসব: ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে আপনার মনে কি স্পষ্ট কোন ছায়পাত পড়ে?

দিশারী মুখোপাধ্যায়: বাংলাভাষা প্রসঙ্গে আমি আগেই আমার আশঙ্কার কথা জানিয়েছি তবে ছায়াপাত বলতে কী বুঝাচ্ছেন তা আমার কাছে পরিষ্কার নয় বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ জনিত ছায়াপাত নাকি বাংলা সাহিত্যের ছায়াপাত আমার উপর? ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্য কী আকার নেবে আমি সে সম্পর্কে একটু ভীত এবাংলায় বাংলাভাষা প্রায় ব্রাত্য ওবাংলায় বাংলা একমাত্র ভাষা হওয়ার সুবাদে লড়াইটা হয়তো কিছু বেশিদিন দেবে কিন্তু গ্লোবাল ভিলেজটি ইংরেজি ভাষার জমিদারী সুতারং ভাষাকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির প্রসঙ্গটি থাকেই আর ভাষাটি বিপন্ন হলে সে ভাষার সাহিত্যও বিপন্ন হয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাভাষার স্বীকৃতি বা পুরস্কার না পাওয়াসে কথাই বলে এই আশঙ্কা আরো প্রকট হয়ে পড়ে যখন দেখি কিছু বাঙালি কবি সাহিত্যিক ইংরেজি ভাষায় লিখে বুকার ইত্যাদি নিয়ে আসছেন বা আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করছেন সেই কারণেই দেশের অভ্যন্তরেও তাদের খ্যাতি তুলনামূলকভাবে অধিক হচ্ছে



নাম - কবি হিসাবে পরিচিত দিশারী মুখোপাধ্যায়: নামে প্রকৃতনাম অমলেন্দু মুখোপাধ্যায়
বাবা ঈশ্বর বলাই চন্দ্র মুখোপাধ্যায় মা বাসন্তী মুখোপাধ্যায়
জন্ম - হুগলী জেলার উত্তর পাড়ায় ১৯৬০সালে
পৈতৃক নিবাস পূর্ব বর্ধমানের পর্বতপুর গ্রামে বর্তমান নিবাস কর্মসূত্রে এবং আপাতত স্থায়ী পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরে
কর্মজীবন - ডাক বিভাগের কর্মচারী, এখনস্বেচ্ছায় অবসরে
আশির দশকে আবির্ভাব
কবিতাই একমাত্র ভালবাসা
সম্পাদিত কবিতার পত্রিকা শব্দগন্ধ, কবিসভা
প্রিয় কবি - আজকের নতুন কবিটি
কবিতার বই - স্পষ্ট বলব না, জলের দেশের গল্প, নাভিকুন্ডে তীব্র হাতছানি, ভৌতিক নূপুর নির্জনে, শামুকপাখিপাতাতুলোমেঘবৃষ্টি, ইমনকল্যাণ কাঁদে চোখ