শুক্রবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮

সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়


সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়

জননী হে

যে বৃষ্টি ঝুঁকে আসে কন্যারউপরে
যে বৃষ্টি ধারাজল ভাসায় রুধিরে
সে বৃষ্টি নেমে আসে শরীরে তোমারও
অনন্তশায়িত ভূমি, বরিষণ পর ও
জলসিক্ত চোখদুটি কী বা খোঁজেপ্রিয়
শব্দ স্বস্তি শান্ত দৃষ্টি যা ছিল দেয়
দিইনি কি সব? তবু শবগন্ধী ভূমি
কেন দ্বিধা দ্বিধাকালে, কাকে খোঁজ তুমি?
তুমি চেন আততায়ী, তুমি চেন ক্ষত
তুমি চেন আর্তনাদ শিশুকন্যা যত
জানিয়েছে বার বার যোনিকর্ষকালে
বিদীর্ণহয়েছ তুমি, তবু এ সকালে
স্নাত ভূমি আজও তুমি প্রকৃতি ঈশ্বরী
কন্যা নিয়েছ পূর্বে আজকরজোরি
ভিক্ষা চাই দীর্ণ হও, কুক্ষিগত হোক
পিশাচের পাপাচার
অস্তে যাক শোক






ঘোষবাবু

লোকে তাঁকে মুদি নামে চেনে
নেই তার কোনো নামডাক
ভেঙ্গে পড়া দোকানের কোণে
সারি সারি ভাঙাচোরা তাক

একধারে চাল আটা চিনি
ছিল বটে, আজ টিন ফাঁকা
দোকানটি হয়েছে তামাদি
তবু তাকে প্রানে ধরে থাকা

খদ্দের নেই আজকাল
জিনিসও পুরোনো। কোন্‌ কালে
স্টক তোলা, মনেও তা নেই
"ভালো কিছু নেই তো কপালে"

রোজই এই গঞ্জনা শুনে
দোকানে বসেন এসে তিনি
গড়িমসি দিন কেটে যায়
সারাদিনে কিছু বিকিকিনি

হয় যদি, হাতে নিয়ে চাঁদ
বাড়ি ফেরা, রোজকার মত
যা জুটেছে তাই দিয়ে ঢাকা
রক্ত শুকিয়ে থাকা ক্ষত।

এভাবেই কাটছিল দিন
এভাবেই নিভছিল রাত
অভাবের সংসারে শেষে
বাড়ন্ত হল শাকভাত


জানলার ফাঁক দিয়ে বৌ
দেখেছিল শূন্যে পা দুটো
কারা যেন ভেঙ্গে দিল দোর
ভেসে গেল স্রোতে খড়কুটো

পরদিন দুপুরের ঝোঁকে
পিওন দুয়ারে এসে হাঁকে
অনলবরণ ঘোষ বাবু
এই ঠিকানায় নাকি থাকে?

লোকে তাঁকে মুদি নামে চেনে
নামডাক নেই তার কোনো
বৌ শুধু তড়িঘড়ি আসে
পিওন সে দেখেনি কখনও

কাঁপা হাতে তুলে নেয় চিঠি
খামের ওপরে তাঁর নাম
ভিতরের চিঠির বয়ানে
কবিকে পাঠানো পেন্নাম

শুয়ে আছে ঝরা ফুল যেন
বৌ খোলে হিসেবের খাতা
আঁকিবুকি কাটাকুটি ফেলে
ফিরেছেন ছন্দ দেবতা






দোঁহে

একফালি এই বারান্দাতে তোমার আমার ভেজা জামায়
জমাট বাঁধা জলের ফোঁটা  আকাশ ছিঁড়ে সূর্য নামায়
ঘরের ভেতর ঘোর লাগিয়ে শার্সি গুলোর ছায়ার ফাঁকে
বারান্দাঘোর মনটি  দেখি রোদ পোহানো দুপুর আঁকে

একফালি সুখ বারান্দাতে  টব  সাজানো ইঞ্চি মাপা
সূর্য যখন অস্তে তখন ফোটায় কুঁড়ি স্বর্ণচাঁপার
কানসোনাটির ঝিলিক ছুঁয়ে গন্ধ মাতায় ঘর দুয়ারে
বিকেল নামে পা টিপে আর সন্ধে ঘোরে আড়ে ঠারে

একফালি সে বারান্দাটায় সুখটি চড়ে রেলিং বেয়ে 
খানিকটা তার ভিতরবাগে, খানিক চাঁদের আদর পেয়ে
আকাশ ছোঁয়ার নক্সা বোনে, ঝালর লাগায় স্বেদকনিকার
গেরস্থালির  আঁধার ছিঁড়ে   ঝিলিক ওঠে স্বর্ণ টিকার

একফালি ওই বারান্দাটা সাক্ষী থাকে জোয়ার ভাঁটার
সাক্ষী থাকে পর্ণমোচীর পাতা ঝরার, গোলাপ কাঁটার
দুই প্রহরের মরু বেহাগ যখন বাজে রুদ্রবীনায়
বারান্দাতে  একলা আমি অপেক্ষাতে তোমায় চেনার






মধ্যবিত্তর মোজা

জোড়া মোজা পাওয়া যায় না কখনও
একা একটা মোজা কোথায় ঘুরতে চলে যায় কে জানে
মেজবাবু দু রঙের মোজা পরে অফিসে দৌড়ন
সারাদিন দম আটকানো ব্যস্ততায় মোজার কথা মাথাতেই আসেনা।
টিফিনে শুকনো আলুর দম, তিনটে রুটি আর সাদা দই
গিন্নী রোজ গুছিয়ে দেন।
ক্যান্টিন থেকে বেশি কাঁচা লঙ্কা দেওয়া ওমলেট কিনবেন কিনা
ভাবতে ভাবতে রুটি শেষ হয়ে আসে
শরৎ চাটুজ্জে মেজবাবুকে দেখে সরে যায় ক্যান্টিনের দরজা থেকে
টাকা ধার করেছে মাস পাঁচেক হল। দেওয়ার নাম করছে না
আলুর দমের লঙ্কাটা মুখে নাড়াচাড়া করতে করতে মেজবাবু ভাবেন
শরতের মাবাবা ওর নাম রাখার সময় বুঝি স্বপ্ন দেখেছিল
ছেলে কথা সাহিত্যিক হবে।
হয়েছেও তাই।
কথা বেচে ধার করে করেই কাল কাটায়
ভাজা মশলার গুঁড়ো ছড়ানো আলুরদমের স্বাদ লেগে থাকে মুখে
আজকাল নাকি কেউ মধ্যবিত্ত নেই, কাগজে বেরিয়েছিল প্রতিবেদন
প্রতিটি মানুষের বেদন না জেনে প্রতিবেদন লেখে কেন কেউ?
মধ্যবিত্তরা জমজমাট আছে।
মফস্বলী লাইনের গা ঘেঁষে সুন্দর ছোট ছোট বাড়ি
যেখানে পাঁচিলের ঠেকনা, সে ছাদে কি বাগানে, লতিয়ে দেওয়া ঝিঙ্গে পুঁই কুমড়ো
চালের ওপর নরম সবুজ লাউ, কলার ঝাড় দু চারটে
মধ্যবিত্তরা আছে,
তাদের জুতোয় ধুলো, ব্যাঙ্কে দুশ্চিন্তা, পোষ্ট অফিসে আপোষ
তদের বৌদের রান্নায় অমৃতস্বাদ
তাদের মায়েদের প্রেশারের ওষুধ
তাদের পাড়ায় বেতের অস্থায়ী বোর্ডে খবরের কাগজে খবর
তাদের মেয়ে না ফেরা অবধি ভয়
ছেলে না ফেরা অবধি দুশ্চিন্তা
তাদের কুলুঙ্গিতে সিঁদুর লেপা ছবি
তাদের ধার দিয়ে চাওয়ায় লজ্জা,
ধার চেয়ে না পাওয়ার তেতো স্মৃতি
সাদা দইটা গরমে কেমন জল কেটে যায়
গিন্নীর সাদাটে ফরসা কাঁধ থেকে নেমে আসা জল দেখেছিলেন বিয়ের পর।
মা কাছাকাছিই ছিলেন।
ফলতঃ সে দেখার স্বাদ ভোগ করতে রাত এক প্রহর
কোথা থেকে কী মনে পড়ে-
অফিসে মন বসে না।
ফাইল খুলে বসে আরও চমক। মধুরিমা সান্যাল।
মধুরিমা নামে একটি মেয়েকে ভালো লাগত কলেজ জীবনে ।
সে এ নয়। ফাইলে বয়স দেখে বোঝা যায়
তবু মধ্যবিত্তর মধ্যক্ষমতা বলে মেজবাবু ফাইলটা ছেড়ে দেন।
ট্রেনের দুলুনিতে চোখ লেগে আসে।
উদ্বাহু দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে নেওয়ার চরমসুখটুকু মেজবাবু ভোগ করেন খানিক
স্টেশন থেকে লোক জুটে যায় রোজ। একথা সেকথা বলা শোনার মাঝে
আধার বানাতে গিয়ে কত কোটি খরচ হয়েছে শুনে ভারি তৃপ্তি হয়
জনতার অস্তিত্বখাতে সরকারের খরচ, অস্তিত্ব তবে মূল্যহীন নয়!
মোড়ের মাথার বাল্ব চুরি হয়ে থাকে স্বাভাবিক অভ্যাসে
অন্ধকার পেরিয়ে বাড়ি ঢোকার মুখে
মধ্যবিত্ত দরজায় মধ্যবিত্ত হাসিমুখে গিন্নী
মোজাটা পেয়েছি জান? ছাদের তারে রয়ে গেছিল...
খুঁজে পাওয়া সামান্য মোজাটি আনন্দসেতু গড়ার স্পর্ধা দেখায় ক্ষণিকে
মধ্যবিত্ত ধুনোধূপের গন্ধ ভাসে পারিবারিক দেওয়াল টোপে।
ছেলের ফেরার আওয়াজে মা খাট থেকে নেমে আসেন ...






সেক্রেটারিবাবু

সারি সারি মেয়েরা মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
বালিকা বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি মারা গেছেন
বালিকারা কেউ চেনেনা তাঁকে, তাঁর কাজও অজানা
শুধু দুটি মৌন মুহূর্ত তাঁকে একবার মেয়েদের কাছে ঘুরিয়ে নিয়ে যায়
বড়দিদিমণি বলেন তিনি কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন
নতুন আসা ভৌতবিজ্ঞানের দিদিটির আফসোস হয়, দেখা হল না...
...রিক্সাওয়ালা নিধুলালও দাঁড়িয়ে থাকে মাথা ঝুঁকিয়ে
তাড়া দিচ্ছিলেন বাবু,তাই গলির বদলে বাসরাস্তা
না হলে তো গলিতেই নামতেন
রেষারেষির বাসের বলি হয়ে যেতেন না
দুবলা পা দুটো দৌড়তে পারলে গলি দিয়েই যাওয়া যেত
আফসোস হয় গলির বদলে বড়রাস্তা ধরার জন্য
... ছাদে রোদ্দুরে পা দিয়ে বৌদিও দাঁড়িয়ে থাকেন মাথা ঝুঁকিয়ে
এই যেখানে এখন রোদ, ওখানেই  জোছনা নেমেছিল
মাদুরে বসেছিলেন দুজনে। মায়ের অসুখের খরচের কথা বলছিলেন উনি
চিন্তিত আঁচড় চোখের পাশে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল
টাকা তুলে আনতে বলেছিলেন...ডাক্তারবাবুকে কল দেওয়া, ওষুধ।
বাইরের রোদ্দুরে মাথা ধরে যায় বলেই...
তাছাড়া সংসারের সব কাজ সেরে আর ভালোও লাগেনা
অথচ একটু ছাতা নিয়ে নিজে গেলে ওই পথ ধরে ব্যাঙ্ক ঘুরে মানুষটাকে যেতে হত না...
আফসোস হয়, একটু না হয় গরমই লাগত
... মাথা ঝুঁকিয়ে থাকে পার্টি অফিসের সমর
'সততা কপচাবেন না' বলে সরে গেছিল সামনে থেকে আগের দিন বিকেলেই
গার্লস স্কুলে পার্টির হস্তক্ষেপে আপত্তি করছিলেন ফালতুতে
আরে সমর কি মন্ত্রী? ওকে তো পার্টি লাইনেই কাজ করতে হবে
তবে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় জ্ঞান ছিল ক'মিনিট
সমরের হাতটা ধরে বলেছিলেন পার্টি থেকে স্কুলটা বাঁচিয়ে দাও...
চোখে জল এসে গেল মাইরি...সৎ লোকগুলো বহুৎ সেন্টি দেয় একা পেলে ...
তবে বেঁচে গেলে হয়ত একদিন বসে আলোচনা করে মাঝামাঝি কিছু করা যেত...
আফসোস হয়, এসব লোকগুলো মরেও তাড়াতাড়ি
দুপুরের দামাল রোদ্দুরে পিঠ পেতে শুয়ে থাকা সেক্রেটারিবাবুর মাদুরটা
অপেক্ষা করে আবার মানুষটা এসে বসবে...
একমাত্র ওরই কোনো আফসোস নেই