শনিবার, ২১ জুলাই, ২০১৮

সম্পাদকের কলমে



সম্পাদকের কলমে!

‘তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে
কত আর সেতু বাঁধি সুরে সুরে তালে তালে’

জলভরা মেঘ। আকাশ ভরা বৃষ্টি। সবুজে সবুজ শ্যামলীমা। নদীনালা ভরপুর। কোথাও কোন কিছুরই কমতি নাই। সবটাই টইটম্বুর। প্রকৃতির উৎসব আজ। বাংলার দিগন্ত জুড়ে। শ্রাবণ এলো ঐ। ঝমঝম বৃষ্টির গমগম গানে আকাশ বাতাস মুখরিত। জল থৈথৈ প্রাণের বীণায় মিলনের সুর। সেই সুরে কাছে দূরে ভালোবাসা প্রেম হয়ে ঝরে। কোথাও সেই প্রেম জীবনের অমোঘ সত্যের চিত্রপটে ভাস্বর। কোথাও বিরহ অনলে ধিকি ধিকি জ্বলে। কোথাও হাতে হাত রেখে পায়ে পায়ে বুকের তালে দ্রিদিম ছন্দের বৃষ্টিভেজা গান। ঘরে ঘরে উজ্জ্বল দীপশিখায় প্রদীপ্ত। কোথাও আবার শিখাহীন দীপ নিরব বিরহে কাতর। জানালা ভেজা শ্রাবণের ছাঁট স্মৃতি বিস্মৃতির মালায় পাওয়া না পাওয়ার বেদনায় ব্যাথা হয়ে ভিজতে থাকে। টুপ টুপ করে। জীবনের দুই কুল ছাপিয়ে আজ শ্রাবণেরই গান। বিরহমিলন রাগে।

যে মেয়েটি বয়সসন্ধির লগ্ন পেড়িয়ে প্রথম শুনতে পেল নিজের নাম। সদ্য পরিচিত উন্মন তরুণের প্রত্যয়ী কণ্ঠে। বৃষ্টিভেজা শ্রাবণসন্ধ্যায়। জলস্থল অন্তরীক্ষ্য প্রত্যক্ষ সত্যের মতো আগলিয়ে নিল দুটি নবীন হৃদয়। এই শ্রাবণ বিশেষ করেই তাদের দুজনের জন্যই শুধু। ওদিকে ছেড়ে চলে যাওয়া যে মানুষটির স্মৃতির ঝাঁপি নিয়ে একলা গৃহকোণে কেউ বিনিদ্র শ্রাবণরজনীর বৃষ্টির শব্দ গুনতে গুনতে একলা থেকে আরও একাল হয়ে পড়ছে এই শ্রাবণ তারও জন্য সমান সত্য। শ্রাবণের বৃষ্টিভেজা দিন বৃষ্টি ভেজা রাত।

কিন্তু শ্রাবণের এই অন্তর্লীন সুর আমাদের প্রতিদিনকার নাগরিক জীবনে কতটুকু ছুঁয়ে থাকে আমাদের? কাব্য কবিতা আর জীবন কতটা পরস্পর পরিপূরক বর্তমান সমাজ বাস্তবতায়? সত্যিই কি ঘরে ঘরে শ্রাবণ এমনই বিরহমিলনের মাদকতা নিয়ে উঁকি দিয়ে যায়? প্রকৃতির ছন্দতাল সুষমা প্রতিদিনকার জীবনে আমাদের মন আর মননের আঙিনায় সত্যই ঠিক কতটা প্রভাব ফেলতে পারে আজ! আর যতটুকু প্রভাবই ফেলুক না কেন, সেই প্রভাব কি এমনই কাব্য সুষমা পূর্ণ সামঞ্জস্যে ভরপুর?

বাংলায় আজ শ্রাবণ মানেই জুলাই আগস্ট! একদিকে বিচ্ছিরি গরম আর মুষলধারে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি ঠিক কতজনের কাছে ঝমঝম সঙ্গীত হয়ে বেজে ওঠে, সন্দেহ আছে। অফিসে যেতে লেট। বাড়ি ফিরতে বিপত্তি। ট্রেনের লাইন জলের তলায়। সিগন্যাল লাল। দমবন্ধ ভিড়ে চিরেচ্যাপ্টা হয়ে মুষলধারে বৃষ্টির মুণ্ডুপাত করবেন, না কি গলা ছেড়ে গেয়ে উঠবেন ‘এমন দিনে তারে বলা যায়?’ নগর কলকাতার অলিতে গলিতে নর্দমা আর বৃষ্টির জল সব একাকার। রাস্তায় রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম। হাঁটু জলে জুতো ভিজিয়ে কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরে শ্রাবণ নিয়ে কাব্য করবেন, না সর্দ্দি জ্বরের চিন্তায় বাড়িতে ক্যালপল মজুত আছে কিনা খোঁজ নেবেন? আকাশচুম্বী পায়রার খোপে থাকলে তো কথাই নাই। অনেক মেহনতে জমানো টাকায় কিংবা চড়া সুদের গৃহঋণে মনমতো পাড়ায় একটা ফ্ল্যাটের গর্বিত মালিক হয়েছেন। ভালো কথা। কিন্তু কাকভেজা জামাকাপড় শুকানোর না আছে উঠান। না আছে ছাদ। একফালি ব্যালকনির ভরসায় হাতের মুঠো আলগা। ছেলে মেয়ের স্কুল টিউশনি সব কিছু নিয়েই শ্রাবণের মুষলধারার সাথে নিয়ত যুদ্ধ করতে করতে হাঁপিয়ে পড়েছেন। রোজকার বাজার দোকান করতে গিয়েও মাথায় হাত। সামন্য লংকা সেও দুর্মূল্য! বৃষ্টির চোটে মাল আমদানী কম। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের লাগাম ছাড়া দামে দিশাহারা। সে সময় আপনার হাতে শ্রাবণসন্ধ্যায় বিরহমিলন কাব্য সংকলন তুলে দিলেই যে আপনি বিগলিত চিত্তে গ্রহণ করবেন তা নাও হতে পারে।

এইখানেই সমাজবাস্তবতার সাথে প্রকৃতির ও কবিতাচর্চার চিরস্থায়ী দ্বন্দ্ব মনে হয়। বেঁচে থাকার প্রত্যক্ষতার সাথে কাব্যচর্চার দৈনন্দিন প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে তাই বিতর্ক থাকাই স্বাভাবিক। সেই বিতর্কেকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েও কবিতা বা কাব্যচর্চাও থেমে থাকে না। আশার কথা এইটুকুই। তাই শ্রাবণের বৃষ্টিস্নাত বিরহমিলন সন্ধ্যা জুলাই আগস্টের মুষলধারায় জলজমা শহরে কি বানভাসি গ্রামাঞ্চলও কবি ও পাঠককে কব্জা না করেও ছাড়ে না। হয়তো এইখানেই মানুষের জীবনসত্যের নোঙর। আসলে মানুষের জীবনের একটা বড়ো মূল্যই তার মন ও মননের দিগন্তে। সেইখানেই বিরহমিলনের কাজ কারবার। এই শ্রাবণের কবিতাউৎসব তাই সেই দিগন্তেই পানসি ভাসাতে আয়োজন করেছে বিরহমিলন সংকলনের। দুই বাংলার সাতচল্লিশ জন কবি সাহিত্যিক সেই আয়োজনকেই সমৃদ্ধ করতে সামিল হয়েছেন দুই শতাধিক কবিতার আসর সাজিয়ে। তাঁদের প্রত্যেকের কাছেই আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। আশা করি কবিতাউৎসবের পাঠকও এবারের আয়োজনের বিশেষত্বে খুঁজে পাবেন মন ও মননের সেই স্বস্তি, যার জন্যেই রোজকার জীবনের ফাঁকফোঁকর দিয়েও সকলেই একটু হাঁফ ছাড়ার অবসর খোঁজেন। সেই স্বস্তিটুকুর নিয়মিত জোগান দিতে পারলেই আমাদের উদ্দেশ্য সার্থক।