সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০১৭

ইন্দ্রানী সরকার




ইন্দ্রানী সরকার

বেদুইন মেয়ে

বেদুইন মেয়ে হেঁটে চলে যায়

নরম পা দুটি পুড়ে বালুকায় |

শুধু খাঁ খাঁ রোদ ধূ ধূ মরুভূমি

ধন্য সে যে আজ নারীর পদ চুমি ||

আলুথালু বেশ, রুখুশুখু চুল

ঘাগরি লুটায়, ঝরে খোঁপার ফুল |

ধ্যাবড়ান টিপ, ধ্যাবড়ান কাজল

রুনুঝুনু বাজে না পায়ের দুটি মল ||

প্রখর রৌদ্রে মুখ তার রাঙা

ঘাড়ের ওপর খোঁপাটি আছে ভাঙা |

কুসুমিত দেহ অনাদরে ম্লান

হেঁটে চলে মেয়ে হাতে নিয়ে প্রাণ ||

দয়িত বুঝি গেছে এই পথে একা

পায়ের চিহ্ন তার বালুপথে আঁকা ||

চলে মেয়ে হেঁটে চিহ্ন আঁকা পথে

চোখের জল ঝরে গভীর বেদনাতে ||

পাবে কি সে খুঁজে মনের বঁধুয়ারে

যে গেছে হারিয়ে বালুকার পাহাড়ে ?

সহসা মেয়ে বালিতে পড়ে লুটায়ে

মরুভূমির বুকের তপ্ত আশ্রয়ে ||





রামুদা কাহিনী

আমাদের বাড়ির বাইরের রকে

একটি লোককে বসে থাকতে দেখতাম ।

তখন অনেক ছোট তাই কে গরীব বা

কে বড়লোক অত বুঝতাম না ।

ভালো জামাকাপড় পরেও যে কেউ

ভিখিরী হতে পারে তাও শিখি নি ।

লোকটির নাম ছিল রামু,

সবাই তাকে রামুদা বলে ডাকত ।



আমি প্রায়ই আসা যাওয়ার পথে দেখতাম

তাকে রকে বসে থাকতে আর

কিছু না কিছু সে খেয়েই যেত ।

ছোটবেলায় রূপকথার গল্পে জালার মত

বড় পেটের কথা ভেবে মনে মনে বলতাম

রামুদার পেটটা নিশ্চই জালার মত বড় ।

একদিন বাইরে বেরিয়ে দেখি সব বন্ধুরা

আইসক্রিম আর ফুচকার ফেরিওয়ালার চারিপাশে

খুব ভিড় করে আছে আর হৈ চৈ পড়ে গেছে ।

আমি ব্যাগ খুলে দেখি একটাও পয়সা নেই ।|

হঠাতই লক্ষ্য করলাম ওই ত' রামুদা

ভাবলাম আবার বাড়ির ভেতর যাব

তার চেয়ে বরং ওর কাছে পাঁচটা টাকা

ধার চেয়ে নিই পরে না হয় দিয়ে দেব ।

ওর কাছে গিয়ে বললাম, ও রামুদা,

পাঁচটা টাকা ধার দাও না,

বন্ধুদের সাথে কিছু কিনে খাব,

পরে তোমায় ঠিক দিয়ে দেব দেখো ।

সে কেমন অদ্ভূত দৃষ্টিতে জুলজুল করে

আমার দিকে চেয়ে রইল।

আমার কেমন একটু অশ্বস্তি লাগল,

আমি একটু রেগেই বললাম,

কি গো কিছু কইছ না কেন?

অমন হাঁ করে কি দেখছ ?

সে এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলল,

খুকুমনি টাকা মাটি, মাটি টাকা।

টাকাকে মাটি করে দিতে আর কতক্ষণ?

আমি মনে মনে ওর মাথায় দুটো চাঁটি মেরে

ঠামুর কাছে ছুটে গিয়ে সব কিছু বললাম ।

ঠামু খানিকক্ষণ আমায় দেখে শান্ত করার জন্য বলল,

খুকু  ওর কাছে টাকা চাইতে গেলি ক্যানো ?

ও ত' জাত ভিখিরী, ওর অভাব কোনদিনই ঘুচবে না,

আর কখনো ওর কাছে কিছু চাস না ।

ওর সারা জীবন কেটে গেছে অন্যের

ন্যায্য ভাগে ভাগ বসিয়ে,

চেয়েচিন্তে কোনমতে দিন কাটায়,

ও আবার ভিক্ষা  কি করে  দেবে ?





যৌথ বলাকা

অতৃপ্তির মায়ামন্ত্র বিনাশ করে

ঐ উড়ে যায় যৌথ বলাকা |

রোদের মেখলা আঁচলে

ঢাকা পড়ে যায় বিবর্ণ শুন্যতা |



নদীর কল্লোলে, ঝর্ণার কলতানে

মধ্যরাতের স্নিগ্ধতায়,

মুক্তি পল্লবিত শাখা প্রশাখায়

মর্মরিত হয় তাদের আনন্দ ধ্বনি |



নিদারুণ অতীতের প্রতারণার

কুয়াশা মায়াজাল ছিন্ন করে,

বাস্তবের রুড় আঁচড়ের আঘাতে

রক্তাক্ত পালক ধুয়ে

আকাশের নীলে ঐ উড়ে যায়

মুক্তিপিপাসু যৌথ বলাকা ||





নবজন্ম

পুরাণে মাছের একটি চোখ

একটিবার ফেরে লক্ষ্যভেদে

বর্তমান মাছ আকারে সুবিশাল

কবন্ধ ছেঁড়া ছেতরানো শরীর

সারে সারে ছুটে আসে তীর

মাছের সাড়া নেই কবন্ধ সে

প্রতিবাদহীন মুখর মাছের ভাষা

মহালয়ার তর্পণে আছে ভক্ষক

লালশাকে এক কোমর জল

কথা কেউ কোনোদিন বলে নি

শুধু নিত্য নবজন্ম পালন হয়

একটি ভঙ্গুর দিনের প্রতীক্ষায় ||





সমর্থন

কোথাও কোন বৈরীতা বা শত্রুতা দেখছি না

শুধুই বন্ধুত্ত্ব, প্রীতি আর সম্প্রীতি

কবির কলম কথা বলার জন্যই সৃষ্টি

তাকে বিনাশ করা যায় না, করতে নেই

যে যার আপনমনে কথা বলে সংসারের

এই জটিলতার ফাঁকে ফাঁকে

একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পাবার জন্য

তাকে অবরুদ্ধ করা মানে তার সৃষ্টির বিনাশ

ক্রমশ: জনসমক্ষে তার অনুপস্থিতি ও অবলুপ্তি

যতক্ষণ না কেউ একই সুরে নিত্য অশ্লীলতা নিয়ে

একই মানুষজনের উদ্দেশ্যে দৌড়ে বেড়ায়

তার কলম মুক্ত, অপ্রতিরোধ্য, স্বাধীন

বাড়ির পাশের চার্চের ঘন্টাধনি এগারোতে গানের সুরে

এই কথাগুলির সমর্থন করে দূরে আকাশে মিলিয়ে গেল ||