বুধবার, ২১ মার্চ, ২০১৮

সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়


সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

রঙ-জীবন
বসন্ত, ১৪২৪
************

জন্মলগ্নে হোলি খেলেছিল চরাচর,
নীল ক্যানভাসে পলাশের সিল্যুয়েট-
কৃষ্ণচূড়ার বেহায়া পরাগরেণু-রা
বিবশ হাওয়ার অনুরাগে অনিকেত।

জলপাইরঙা সবুজ খামের ঠিকানায়,
মুহূর্তগুলো সিঁদুরে আবিরে বন্দী-
তরুণ আকাশে ওড়ে জমকালো চাঁদিয়াল,
সলমা জরির রাত্রি-রা মধুগন্ধী।

পাতাঝরানোর মরসুম হলে শেষ,
মাঘের সূর্য উত্তরায়ণ পার-
পশ্চিমাকাশে শেষ কমলার দীপ্তি,
কে যায় পেরিয়ে, নিকষ অন্ধকার?

অন্ধ দু'চোখে ভিবজিওরের স্বপ্ন,
ক্যালিডোস্কোপে জীবনের জলছবি-
সব রঙ শুষে ব্ল্যাক হোল ডাকে-- আয় রে,
শূন্যে জন্মে, শূন্যে বিলীন হবি।







ভারতবর্ষ 
********

একটু একটু করে পুড়ে যেতে যেতে,
শৃঙ্খলের শব্দ আনে মুক্তির স্বাদ---
পোড়া মাংসের গন্ধে মেশে,
তিলান্নের ঘ্রাণ,
যত নারী, কন্যাভ্রূণ, নিচের মহল---
অক্ষয় স্বর্গ পাবে!
ঐ শোনো, দূরে, সমস্বরে,
জয়ধ্বনি করে---
নতুন সে দেশ এক--- ভারতবর্ষ!

পিছোতে পিছোতে পিঠ ঠেকেনি দেওয়ালে,
দাঁড়িয়েছে নিতল এক কবরের কিনারায় এসে---
আরো, আরো পিছু হটো---- ভয় নেই--
পৌঁছবে সোজা সেই বেহেস্তের দ্বারে,
ঈশ্বর প্রহরী যেখানে।
ঐ শোনো, দূরে, সমস্বরে,
জয়ধ্বনি করে,
নতুন সে দেশ এক--
ভারতবর্ষ!

মাজারে, মন্দিরে,
যত সাধু আর পীরে,
আর্য ও দ্রাবিড়ে,
বড় মেজো ছোট জাতে,
হানাহানি করে ---

এই পৃথিবীর
শ্রেণীহীন, বর্ণহীন দেশেদের ভিড়ে,
তসবি, ত্রিশূল, খাপ পঞ্চায়েত নিয়ে---
একটি সে দেশ জাগে পরম্পরাময়--
নতুন সে দেশ এক,
ভারতবর্ষ!







কাব্যিক?
********

দ্বীপের নামটি বিষণ্ণতা,
পথের নামটি একা-
শঙ্খনদীর ছলাৎ ঘাটে,
তোমার সঙ্গে দেখা।

নদীর জলে বাঁধ দিয়েছি,
শূন্য দিয়ে ভাগ
করেই যাব--- তোমার সিঁথেয়
ইচ্ছেকালির দাগ।

লক্ষতারার কল্পনা ওই,
একশো ছুরির ঘায়ে-
হারিয়ে গিয়েও বসত করে
নেই-আকাশের গায়ে।

ধানের দুধে, মাটির ঘ্রাণে
মায়ের মুখের গান,
শিশুর শোনা প্রথম ছড়া,
''নদেয় এলো বান''--

তাসের সাহেব, তাসের বিবি,
তাসের গোলাম নাচে---
কাগজমানুষ শুধুই ঋণী
বর্ণমালার কাছে।

কাজপাগলের আকাশ ঢাকে
অসুখরঙের কালো,
ঈশ্বরও আজ বায়না ধরেন,
''একটা পদ্য বলো!''







আমার পশ্চিমবঙ্গ
****************

আমার পশ্চিমবঙ্গ মানে
তেতে ওঠা রেলগাড়ির একলা দুপুর,
বিষহরির মলম, লক্ষ্মীর পাঁচালি, আর দিলখুশের শোনপাপড়ি ডেকে যাওয়া চেনা চেনা সুর--

আমার পশ্চিমবঙ্গ হেঁটে যায়
নিঃসঙ্গ আলপথ বেয়ে
ঘুঘুচরাচরে---
অঘ্রাণের ভোরে, তার নিকোনো দাওয়ায় ভাসে আশকেপিঠের ঘ্রাণ।

আমার পশ্চিমবঙ্গ দুই বেণী, নীলপাড় শাড়ি আর
ঘামতেলে চকচকে শ্যামলা কপালে,
পরীক্ষার শেষ ঘন্টা---
রিনরিনে গলা--
'দিদিমণি দিদিমণি, পৃষ্ঠা দিন আরো---''

মোহনার নোনা হাওয়া, ধুধু জল
চিঠি লেখে
পাহাড়ের কাছে---
পাইনের বন, সবুজ চায়ের গাছে,
মেঘ আর কুয়াশার অলীক উঠোনে
একফালি মন তার বাঁধা পড়ে আছে।
সে চিঠির বার্তাটুকু পৌঁছে দিতে হবে--
মাঠঘাট, ধানক্ষেত ঝোপঝাড় ভেঙে
আমার পশ্চিমবঙ্গ ছোটে--
মুখচোরা, লাজুক এক ডাকহরকরা।

আমার পশ্চিমবঙ্গ যেন ভাদুগান হয়ে,
বেঁচে থাকে
রাঢ়ভূমে, রাঙামাটি পথে।

তবু,
নক্ষত্রখচিত কোনো উৎসবের রাতে,
আমি,
নাগরিক যাদুকরী,
খুঁজে খুঁজে মরি
ভাঙাচাঁদ---
রুপোরঙ ভাগীরথীর ঢেউয়ে-

এই সবজান্তা, নষ্ট শহরটার বুকে,
বারাঙ্গনা নগরীর
সেতুর পাঁজরে,
ছুটে চলা জীবনের উজ্জ্বল আঁধারে,
আমার পশ্চিমবঙ্গ একা---

ভাষা, ভালবাসা আর উত্তাপ নিয়ে,
আমার পশ্চিমবঙ্গ
জানি, ঠিক জেগে আছে।







কবিতাযাপন
************


রুখু চুলে হার্ডলরেসের রোদ্দুর,
কপালে ক্লান্ত ঘাম,
ওষুধের ক্যাশমেমো,
ইলেকট্রিকের বিল,
মাসকাবারি মুদির হিসেব-
তেলচিটে কাগজে শুয়ে
ছোঁয়াছুঁয়ি জীবনের অক্ষর----
তবু,
হেমন্তের বিষণ্ণ বালিয়াড়ি ভেঙে,
কুয়াশার পদচিহ্ন এঁকে,
মায়ের স্পর্শ নিয়ে,
কবিতা-রা আসে।
আধোঘুম চাঁদের কপালে যেন টিপ দিয়ে যায়।


মিছিলশহরে সব বিকিকিনি শেষ হলে,
বন্ধ দোরের পিছে,
জেগে ওঠে আদিম বাজার।
আদর, সঙ্গম, চুমু
কেনাবেচা কড়ায় গন্ডায়---
দুটো শরীরের মাঝে
অতৃপ্ত অদৃশ্য দেওয়ালে
রেটচার্ট ঝুলে থাকে
নীলকণ্ঠ হয়ে।
তবু,
নিয়তির মুঠোভরা
গন্ধরাজ ফুলের সুবাস নিয়ে,
ছায়াময় নৈঃশব্দ্যে
লন্ডভন্ড বিছানায়,
কবিতা-রা নেমে আসে,
কানে কানে বলে যায়,
''ভাল থেকো''


একদিন--
দিকশূন্য প্রান্তরে,
কিংবা কোনো আশ্রমবন্দরে,
ল্যাপিস লাজুলি রঙা শামিয়ানার নীচে,
দু'জনের দেখা হবে ঠিক।
কবিতাশিশুর ওই জাতিস্মর জনক জননী---
ছুটন্ত পৃথিবীর পায়ে,
লোভ, কাম, মোহ
আর অবকাশ
গচ্ছিত রেখে চলে যাবে তারা,
জীবনের বীজমন্ত্র তুলে নিয়ে ঠোঁটে,
''ভাল আছি।
কবিতা-রা, তোমরাও খুব খুব ভাল থেকো''