শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

শর্মিষ্ঠা ঘোষ




শর্মিষ্ঠা ঘোষ    

জেরবার , বড় জেরবার কর হে অহম
খ্যাতি বদনাম লাভ লোকসান দ্বন্দে
প্রকট ধন্ধ যোগ্যতাসূচী কোন মাপ
পা নাকি পাদুকা নাকি বারোয়ারী গপ্পে

নাক বরাবর আলো আলো এক রাজ্য
এক চুল তার ডানে বামে গেলে ফক্কা
কোন হরিদাস কোন তৌলেতে মাপছে
কোন সংজ্ঞায় চোস্ত নাকি ভাঁট নিশ্চিত

গ্যালন তৈলে মোটলি ভিজেছে জবজব
গুপচুপ কিছু তোল্লাই আছে পশ্চাৎ
তারও ফাঁক গলে বাঁদর খেয়েছে পৃষ্টক
তোলাবাজদের নিগূঢ় কলমে ছাইপাঁশ

বারফাট্টাই ষোল আনা ছেড়ে আঠেরো
সেই ভাঁড়ুদাস জেনেও নাবুঝে জব্দ
ছড়িটি পেয়েছ আনসান পিঠে মারতে
ভেবোনা হিসেব মিলছে তোমার খেরোতে



রেল

চোখ একটি ন্যাকাবোকা অরগ্যান । ভাবতাম এককালে । একদিকে বয়ঃসন্ধি ভাঙচুর আরেকদিকে ময়ূরকন্ঠী রংবদল ঘিরে ধরছে পুরোনো ভালোলাগায় , খুনসুটিগুলো আদতে প্রেম হয়ে উঠছে , চোখ সবার আগে গদ্দারি করছে আমার সাথে । এ বাবা , একে না সেদিনই আগুনঝরা চোখে নস্যাৎ করেছি , আজ তাকে দেখেই নতমুখী আদুরে বেড়ালটি হয়ে উঠেছি নিজেকে লজ্জা দিয়ে । তারপর দেখি কালক্রমে দুই চোখের মাঝখান দিয়ে স্বপ্নের ন্যারোগেজ লাইনে চলছে স্কুলবেলার রেলকম ঝমাঝম । তার এক কামরায় ফিজিক্স বইএর মলাটে লুকোনো রুশদেশী রূপকথা । ভেস্টিবিউল দিয়ে যাতায়াত করছে শতাব্দীর সেরা প্রেমের কবিতা । রোম্যান্স নিয়ে হা ডু ডু করতে করতে পথে সাইকেল আটকে দাঁড়ানো অপরিচিত যুবকটি খোঁজ করে উঁচু ক্লাসের দিদির । দিদির বাবা পুলিশ অফিসার । ভয়ে বদলে ফেলি রুট । আফসোস করি , হায় , এখনো তেমন ডাগর হইনি , যতটা হলে হ্যাপি প্রিন্স হাঁটু মুড়ে প্রোপোজ করে । এখন সিঁথিতে বিকেল বেলার ব্রডগেজ ।

গাদা ভুলের মালগাড়ি দুলকি চালে কু ঝিকঝিক । সিগন্যালে পতাকা নাড়ছে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা । ঝাড়ি মারছি একবার আপ একবার ডাউন লাইনে । পেরোবো কি পেরোবোনা করতে করতে লাল হয়ে গেল বাতি । অগত্যা রেল লাইনে গলা দিচ্ছি , মাথা দিচ্ছি না । 

                             
কাল্পনিক

তার দুখানা প্রোফাইল । একটি ফটোশপ করা । সে নিজেই নিজেকে দেখে মোহিত হয়ে যায় । ফেসবুকে যারা আহা মরি মরি করে , সামনা সামনি চিনতে পারে না । তখন সে গন্ধর্ব থেকে গাবলু হয়ে যায় । ছোটবেলার বন্ধু এসে দিব্যি চাঁদিতে টোকা মেরে বলে যায় , ‘শালা ,সেই একইরকম খচ্চর আছিস’ ! সে জানে , সত্যি সত্যি খচরামি করতে পারলে , মানে করার মত ক্যালি থাকলে ওসব ভার্চুয়াল মেয়েবাজি করতে হত না । আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত চারমিনারের ছ্যাঁকা তাকে মনে করিয়ে দেয় আজ মাসের সতেরো তারিখ , আর মেয়ের টিউশানের  টাকা বাকি । বউ ফেসিয়াল করার টাকা না পেয়ে রাতের বিছানায় ছুঁতে দিচ্ছে না । ছেলে একটা স্প্যানিশ গিটার কিনতে চাইছে তিনমাস ধরে । সেদিন বন্ধুদের মাল খাবার গেট টুগেদার শরীর খারাপ বলে কাটিয়েছে । বসের বাড়ির বাজার করে দিতে হবে কাল । বসের গিন্নীর তল্পিবাহক হতে হবে । নিজের বউএর সাথে কতদিন রাস্তায় হাঁটে নি । একসাথে বেরলেও দুজনের মাঝে আরো চারটে লোকের ব্যবধান থেকেছে । বিয়ের পর দু একবার সিনেমা আর আত্মীয় কুটুম বাড়ি গেছে বটে , বউএর রজনীগন্ধা সেন্টের সাথে তার ওল্ড স্পাইস ম্যাচ করে নি । মাঝখানে সেই ঢুকে গেছে শহরের ঘেমো বিকেল তোলা উনুনের ধোঁয়া বাড়ি ফেরত ভীড় । এখন মেলায় গেলে হারিয়েই যেতে হবে বোধহয় । তারপর মাইকে কেউ নাম ফুঁকবে একটা হারিয়ে যাওয়া লোকের , যার পরনে ছিল বিধ্বস্ত জীবন , যে নিজের নাম চিনতে পারছে না , মাইকের গাঁক গাঁক বৃথাই মনে করাতে চেষ্টা করছে লোকটির বয়সের গাছপাথর । লোকটি খুঁজছে ফটোশপের লোকটিকে । যার নাম কাল্পনিক ।



সুন্দর

সেদিন সকাল থেকে খুব বৃষ্টি । সেদিন সকাল থেকে বকুল গেঁথেছে সুধা । সেদিন নীল পাহাড়ের গায়ে মেঘ পিওন ছড়িয়ে দিয়েছে চারুলতার চিঠির টুকরো । সোনার তরীর বৈঠা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না । শিলাইদহে প্রজারা সার বেঁধে বসে আছে কিসের শঙ্কায় । অমলের খুব শীত করছিল । বদ্যি এসে দেখলেন , সে ডেলিরিয়ামে এক সাধুর সাথে কথা বলছে । তাঁর গায়ে সাদা জোব্বা । দুধে আলতা গাত্রবর্ণ । তিনি তাকে গল্প বলছেন । রতন এসে খবর দিল , কোলকাতা থেকে লোক এসেছে । কবি আজ যাবেন । অনেক দূরে । সবাই কাঁদছে তাই । সবাই তাঁর পেছন পেছন ছুটছে । তাঁর গান গাইতে গাইতে । কবি কিন্তু নির্বিকার । ঠোঁটে যেন স্মিত হাসি লেগে আছে । মুদিত চোখে উপভোগ করছেন মোহরের গান । আশ্রম বালকের দল প্রার্থনা করছে । লালমাটির দেশে পলিমাটির দেশে গঙ্গায় পদ্মায় শিলং পাহাড়ে মংপুতে চীনে রাশিয়ায় ইংল্যান্ডে রানীর সভায় রাজার দরবারে মৈত্রেয়ী দেবীর খাতায় রানুর মিতালীতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর মুগ্ধতায় বৌঠানের শাসনে এক বিস্ময় বালক এক তুখোর কিশোর এক প্রশান্ত যৌবন এক শোকার্ত পিতা এক বিদগ্ধ প্রৌঢ় এক ঋষিপ্রতিম শিক্ষক রূপ থেকে রূপান্তরে কাল থেকে কালান্তরে পরিণত হতে হতে ছাতার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছেন বাঙ্গালীর বক্ষ জুড়ে তৃষ্ণা হরে তৃপ্তি হয়ে আলো হয়ে প্রিয় হয়ে প্রেম হয়ে , শোক ভুলে উঠে দাঁড়াচ্ছে জাতি মঙ্গল বারতায় সত্য সুন্দরে বিরাজিত ।  



লাড্ডু

সিঙ্গল বেল হলেই জিঙ্গল বাজবে জাস্ট ইশারায় ভেবে নিচ্ছে বিকশিত শ্বদন্ত । প্যাভলভের থিয়োরি লজ্জাহরা ঝরতে থাকে হ্যা হ্যা । ফাঁক ফোঁকরে শেয়ালেরা হায়েনার চটিতে পা গলিয়ে ফেলে ।

দরজাটা হারিয়ে ফেলা জরুরি হয়ে পড়েছে । তা নইলে ঘুরঘুর ফুরোচ্ছে না । দিনমান নেশাগ্রস্ত টুকি । আসে কি আসে না , দেখে কি দেখে না । ভীষণ তৈলাক্ত হাবুডুবু , অবশেষে বিবমিষা বিবমিষা ।

খাপ খুলতেই যা দু মিনিট । একবার সাধিলেই খাইবো । লালা ঝরছে তো ঝরছেই ।  কতবড় ল্যাজ বোঝা মুশকিল । সেই পথে তো দেখা হয় নি আগে । সব হিমালয় নাকি টিলা , দিল্লীকা লাড্ডু জানে ।

অপেক্ষা করছি কখন ন্যাচারালি তলিয়ে যায় । একটিবারও আর ছিপ ফেলতে চাই না । আশপাশ দিয়ে যাবো । ফিরেও তাকাবো না । বুঝতে দেবো না , একটিমাত্র পিং এর জন্য আমিও সবিশেষ সারমেয় জন্মে গড়াগড়ি দিতে পারি ।

হে আমার উষ্ণীষ হে আমার পলকা খোপের ল্যাকপেকে লোভ , ব্রেক দাও , ব্রেক দাও , জলাঞ্জলি যাবার আগে তল্পিতল্পা নিয়ে ফিরে যাও শান্তিতে স্বস্তিতে দারিদ্রে অপরিচয়ে গরবে উন্নত শির স্বাতন্ত্র জিহাদ ভালোথাকায় ।