শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

রাবেয়া রাহীম




রাবেয়া রাহীম

একটি চিঠি দিও
---------------------
শেষ বিকেলের ফেরত ডাকে
না হয় মনের ভুলে একটি চিঠি দিও---
তোমার আংগুল ছোঁয়া লেখায়
এক চিলতে ঝলমল হাসি বইতে দিও
মনের কোণে শত স্মৃতির ইতিউতি
তাকিয়ে থাকি--ভাবতে থাকি,
তুমি ভালো আছো তো এখন?
সাঁঝ বাতির সতেজ আলোয়
নীল ডায়েরির পাতায়---নিখুঁত নকশায়
অপেক্ষাদের জমা রাখি ।।
ছুটির দুপুরে ভাতঘুম শেষে
হৃদপিন্ডে তোলপাড় করা ভালবাসায়
আমার নামটি স্মরণে নিও--
মনের ভুলে একটি চিঠি দিও ।।




অবয়বহীন অনুভুতি
---------------------
অবয়বহীন অজানা অনুভূতিগুলো হামাগুড়ি দিয়ে এগোয়
কড়া নাড়ে অবিশ্রান্ত ভাবে চৌকাঠ পেরোনর অভিপ্রায়ে
আকাশের ওপারে আরেকটা আকুল আকাশ তাকিয়ে থাকে নির্বাক !
দীর্ঘশ্বাস গুলো বুক থেকে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।।
নৈঃশব্দ্যের পথ পাড়ি দিয়ে নীরব যাত্রায়
মায়ায় ঘেরা নেশাতুর হাত
কাঁপাকাঁপা আঙুল গুলি অন্ধকারের ধুকপুকুনি
কাশের শ্বেত শুভ্র ফুল আশ্চর্য পবিত্রতা
শাড়ির আঁচল বিছানো অনিঃশেষ বসন্তকাল--অনন্ত ভোরবেলা
সুখের গাছের চিরল পাতায় কেঁপে উঠে নিমিষে বিবাগী।।




চল্লিশ পেরিয়ে
-----------
চল্লিশ পেরিয়ে, মন কি যেন বলে উদাস সুরে
ঐ কি দেখা যায় বলিরেখা, কপালের ভাঁজে
কাজল কালো হরিণ চোখের বাঁকে !
আমার রোদ্দুরদিন,অবাধ্য সুখের বেহিসেবি লহর
সকল কেবল সাদা কালো হতে রয় ;
ফিকে হয়ে যায় অন্তঃপটের বিস্তীর্ণ মাঠ প্রান্তর-
চোখের সুড়ঙ্গ ধরে একটা বিচ্ছিন্ন ছায়াপথ !!




আক্ষেপ
-------------------
প্রচন্ড হিমেল হাওয়ায় ধরণী কাঁপিয়ে তুষার ঝড় বইছে
কালবৈশাখী অনেক দেখেছ তুমি--অনি ,
কিন্তু শীতকালের তুষার ঝড়,
বাতাসে ভেসে থাকা হিমশীতল বরফের কুচি
কি ভীষণ ভয়ংকর জমাট ঠাণ্ডা নিয়ে আসে!
সেটা তোমার জানা নেই!!
এই সময়ে মনে পড়ছে তোমার কথা ভীষণ---
বাড়ির পূর্ব পাশের আমবাগান! মনে আছে?
ঝরে যাওয়া পাতার উপর অজস্র আমকুঁড়ি,
দামাল হাওয়ায় উড়ে যাওয়া দোপাট্টা
তোমার গায়ে লেপটানো ভেজা শার্ট,
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ভেজা দুজন
আর মাদক চাহনি।।

আমিও যে তোমায় নিয়ে ভাবছিনা
এতোটা নিষ্ঠুর ভাবনা কেমন তরে ভাবতে পারলে -- সু !!
আমার সময়ের দুপুর থেকেই টিভির খবরে চোখ আটকে আছে
যদিও জানি এখন তোমার গভীর রাত,
কপালের উপর কিছু চুল এলোমেলো
ঘাড়ের কাছে উচ্ছ্বল চুলের ঝিকিমিকি
পরনে সাদা অথবা তোমার প্রিয় নীল রঙের রাত পোশাকে অপরুপা তুমি
বিছানায় শান্তির ঘুমে !! তারপরেও মন কি আর মানে!!
তোমার পাশে না থাকার আক্ষেপে
ঈশ্বরের কাছে তোমার মঙ্গল প্রার্থনায় কাতর হয়ে আছি!






নৈঃশব্দ্যের নোনাজল

"কবিতাটিতে আবেগী ভাব বেশী লাগছে—
ভাষার গভীরতা রেখে যদি আরও একটু সংক্ষেপ করা যেত",
এই বলে কবিতার খাতায় কিছু একটা লেখার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়তে চায় অনি।
পুরোনাম অনিকেত--চশমার নীচে অনেকটা ঢেকে যাওয়া কালির রেখা,
প্রায় রাত্রী জেগে থাকা লাল দুটি চোখে অবাক করা ভাল লাগা নিয়ে তাকায় সে,  
শীতের মিষ্টি বিকেলের আবেশ ছড়িয়ে থাকে যেন তাঁর অবয়বে সারাক্ষণ।
এক সময় প্রচুর সিগারেট খেত তাই ঠোঁটে
নিকোটিনের কালো দাগ আলাদা একটা মাধুর্য এনে দেয়।
চুপচাপ বিষাদী মেঘ আর অস্ফুট কিছু বিষন্নতায়
শেষ বিকেল গড়িয়ে পড়েছে সন্ধ্যার বুকে,  
নিভু নিভু আলোতে এই আবছায়া সময়টা বড়ই অদ্ভুত,
আর আমি রন্ধ্রে রন্ধ্রে কেঁপে যাই অবাক শিহরণে!
অনি আর আমি একই কবিতা ক্লাবের মেম্বার
দুজনেই সমবয়সী, বয়সের হিসেব আর নাইবা করলাম;
তবে দুর্দান্ত--উচ্ছল যৌবন পেরিয়েছি অনেক আগেই
সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
কবিতার সাথে বন্ধুত্ব আমাদের দুজনের।
মাস খানেকের পরিচয়।

সন্ধ্যে নামছে ল্যাম্পপোস্ট ছুঁয়ে প্রাণোচ্ছল এই শহরে;
ধিকিধিকি শ্বাসে জেগে থাকা এই আমি নিজেকে ছুঁড়ে ফেলি
চাওয়া পাওয়ার হিসেবের ভেতরে
তারপর কেটে যায় কিছু বিনিদ্র রাত।
পোড় খাওয়া দুজনের জীবনে
আর গদ্য আনতে সাহস করি না কেউ।
চেপে যাই----অনেক না বলা কথা।
বহুদিন আবৃত্তি শুনেছি তাঁর ভরাট কন্ঠে
'বাতাসের ওপারে বাতাস—
আকাশের ওপারে আকাশ।......'
অনি কবিতা ভালোবাসতো,
আর আমি অনি কে ।

কবিতা ক্লাবের পাশেই তির তির করে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ জলের শান্ত নদী।
দুজনেই নিজেদের গাড়ী চালিয়ে আসি দু'কিলোমিটার পথ মাত্র
দুজনের ভেতরেই না বলা অনেক কথা গুমরে উঠে ।
একদিন অকারনেই দুজনে নদীর তীর ধরে হাঁটতে থাকি
অনি কি কিছু বলতে চায়?
আমি কি কিছু শুনতে চাই?
হঠাত অনি আমার হাতটা নিজের হাতে তুলে নেয়।
শেষ রাতের কয়েক পশলা বৃষ্টি নামার প্রশান্তি অনুভুত হয়,
কেমন যেন ভিজে গেলাম আমি,  
ঘোর লাগা আমি তাঁর ঠোঁটে আঙ্গুল ছুঁয়ে বুঝলাম
তাঁর বুকেও ডাকছে মেঘ, এবার বুঝি বৃষ্টি নামবে।
সেদিন উচ্ছল চোখে তাঁর মুখের দিকে মুগ্ধ চেয়ে বলেছিলাম
"তোমার চোখে সময়কে যদি আটকে দিতে পারতাম"
অনি হেসে বলেছিলো-- "পাগলী--সময়কে কিভাবে আটকাবে!"
---হ্যাঁ সে ঠিক বলেছিলো,
সময় কে আটকানো যায় না ।
আমরা পারিনি।
মোহাবিষ্ট আমি আপন মনে শুধু বলতে পারলাম তুষার ঝরুক
সূর্য উঠুক হিমেল হাওয়ায় ধরনী কেঁপে যাক
তাতে কি বা আসে যায় যদি তোমাকে পাশে পাই,
আত্মসমর্পণ অনিবার্য ছিল বুঝেছিলাম তাঁর গভীর আবেগীয় দৃষ্টিতে ।।

আচমকা শহর ছেড়ে চলে যেতে হলো,
অনির সাথে দ্যাখা নেই প্রায় দশ বছর।
মানুষের জীবনের পরিসীমা খুব সামান্য
আরও কি দশ বছর কেটে যাবে বা
তারও বেশী কিছু বা জীবনের শেষ সময়!
তাকে বলা হয়নি কখনো
তাঁর ভরাট গলায় আমি আবিষ্ট হয়ে পড়তাম।
তাকে বলা হয় না---
তাঁর অসাবধানতাবশত শার্টের বোতাম খোলা থাকলে
তাঁর রোমশ বুক দেখে আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়তাম
কিংবা কি যেন!
আমার কাছেই কেবল অদ্ভুত লাগে তার সব কিছু!

মাঝে মাঝে আমার সন্ধ্যেগুলো এতোটা বিমর্ষ হয়
বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে যেন এক গাঢ় শূন্যতার হাহাকার!
তখন মধ্যরাতের এই বিশাল নিঃসঙ্গ নিস্তব্দ আকাশটাকে
খুব আপন মনে হয়!
ইচ্ছে করে দু'হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরি!
বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশিয়ে ফেলে চিৎকার করে কাঁদি,  
খুব কাঁদি...!

"অনি আর আমি" এই নামে একটি কবিতা লিখব কিন্তু শেষ করা হয় না।
তুমিও কি এভাবেই আমাকে নিয়ে লিখতে চাও, অনিকেত?
আমার কবিতার সবটাই তো একেকটা চিঠি,
ছন্দহীন গদ্য সব! তোমাকে না বলা সব কথা !

বলছি শুধু তোমায় অনি--আমার কবিতার খাতা তোমার নামে করে দিলাম
পাতায় পাতায় ছোঁয়া তোমার স্পর্শ আমার হবে বলে
                  তোমার আঙুলে জড়িয়ে থাকব ভালবাসার পরশে।।