বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৬

মৌ দাশগুপ্ত



মৌ দাশগুপ্ত

শীত

শীত-১
তোমাদের ঘরে এই যে চার দেওয়ালের সীমাবদ্ধ পৃথিবী,
দুই টিকটিকির মিছামিছি লড়াইয়ের ছায়ার নিষেধের ত্রিভুজ,
চৌকোনো জানলায় দোলদুলন্ত গাছেদের উৎসব
মাকড়সার জালে ছটফটানো বাচাল হাওয়ার শীৎকার
কাঁচপোকার শরীরে হেঁটে যাওয়া শিহরণ,
ভাবি,ঘরের বাইরেই তো পাতাঝরা শীতার্ত রাত,
ভেবে ভেবে খুলে ফেলি উলের টুপি, দস্তানা, মোজা,
আঙ্গুলচেনা ক্ষতচিহ্নের পাশে ছায়াছবির মত মূক প্রতীক্ষায় থাকে ওরা,
শীতরাত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়ত হয়,
ঘরের ভিতরেও হিমযুগ,ঘর্ষণেও আগুন নেই।
ধোঁয়া ধোঁয়া শৈত্যে হিম হয়ে আসে নপুংসক রাসমঞ্চ।



শীত-২

রোজ যা ইন্ধন পাই তাতে আগুন জ্বলেনা,
উষ্ণতার খোঁজে শব্দের ওপর দিয়ে ছুটে যায় শীতার্ত কলম,
পাতা ঝরা শীতের চুমু চুমু রাতে জুটিয়ে আনি যত ক্ষোভ ,
বিদিশা রাত নেমে আসে চুপিসাড়ে, পাখীরা ঘুমিয়ে গেলে অন্ধকারে
নদী আর সাগরের সঙ্গমে শরীর থেকে ভেসে আসে মোহানার জলজ গন্ধ,
মাটির আদিম জঠরে জমা হতে থাকে বিন্দু বিন্দু শীত !
রূপোর কাঠি ,সোনার কাঠির ছোঁয়ায়  হিমযুগ আরো ঘনিয়ে আসে।
নীল জোৎস্নায় ক্রমশ ঈশ্বরবিলাসী হয়ে ওঠে প্রাগৈতিহাসিক সময়,
আদিম পুরুষের মত একা আমি সেই নৈঃশব্দকে ভোগ করি ।



শীত-৩

জানলার কাঁচে শীতার্ত জলবিন্দু,
চিরাচরিত প্লবতায় নেমে যায়  মাটির দিকে,
অসীম মমতায় কাঁচের উল্টোপিঠে গাল ছুঁইয়ে বুঝে নিই
ঠিক কতটুকু উষ্ণ হলে চুম্বনে তপ্ত হবে শীতের সকাল।
বারবার ছুঁয়ে দেখি  হাওয়ার উড়ু উড়ু বেহিসাবীআঁচল।
এখনো রোদরঙা গুঁড়ো গুঁড়ো মেঘ লেগে আছে।
পরিযায়ী মন,শীত তো এসেই গেছে,
কবে ফিরবি শবরীর প্রতীক্ষাঘরে?



শীত-৪

শীতজোছনায় ফুরিয়ে যায় হলুদ ক্যালেনডুলা দিন।
মাঠ জোড়া সরষ ক্ষেতে হলুদও ম্লান হয়ে আসে।
কম্পমান শিশিরের ফোটায় নীল হয়ে আসে ঋতাচারি নখ।
অঙ্গাঙ্গী আবেষ্টন তৃষায় শীত নামে গৃহস্থের বিছানার চাদরে।
পোড়ামাটির ভাস্কর্য্যে যেমন লেগে থাকে নৃত্য ও নাট্যমুদ্রা
শীতের নক্সীকাথাঁয় লেগে থাকে অলীক চন্দ্রমল্লিকা রাত।



শীত- ৫

সময়ের পরাজিত আঙুলে লেগে আছে যুদ্ধকালীন ক্ষত।
কতটা পথ গেলে সঙ্গমতৃপ্ত হয় নদী,
কত ঢেউএর আঘাত সইলে নিশ্চুপ হয় ধুধু বালুচর
কত রাত শেষে চড়ুইপাখী দেখে একটা নিটোল সূর্য্যোদয়,
তবু নিরুত্তর সময়।
আমি শুধু জানি  সাগরসঙ্গমে নদী শেষ হয়,
ধুধু বালুচরের পর পড়ে থাকে অন্তহীন পথ,
সূর্য্যোদয়ের পর রোদরাঙা হয় চড়াইয়ের শীতার্ত ডানা,
আঙ্গুল কিন্তু জানে শুধু ক্ষতের যন্ত্রণা।



শীত- ৬

আমার নকশীকাঁথায় শীত জুড়ে জেগে ওঠে,
দারুচিনি এলাচের বন,
উজ্জ্বল চন্দ্রমল্লিকা দিন উঁকি দেয় লেপঢাকা ঘুমঘুম চোখে।
চশমার কাঁচে গাঢ় হয়  ধূমল কুয়াশার অজানিত ঘ্রাণ,
চায়েরকাপে দিনের প্রথম চুম্বন রেখে
থিরথির কম্পনে তোমার বুকের স্পন্দন খুঁজে বেড়াই,
মোবাইলের স্ক্রীনে ছোট হয়ে গুটিয়ে আসে পুরো পৃথিবী।
হলুদ সরষের ক্ষেত ভরে জেগে ওঠে পৃথিবীর যাবতীয় লাবণ্য,
আমি তার মধ্যে তোমার চুমুচুমু ভালোবাসা রেখে আসি,



শীত-৭

গ্রহণ লেগেছে,ফুরিয়ে যাচ্ছে সুর্য্যমুখী দিন।
নক্ষত্রের ঘ্রাণ মেখে আকাশ চেয়ে আছে  অনিঃশেষ,
ম্লানকুয়াশায় মুছে যাচ্ছে চার দেয়ালের যতি
দিগন্তে দৃশ্যান্তর,
দৃশ্যের অপর পারে নিভে আসছে মানুষের চোখ।
রাহু কেতু নয়,সূর্য্যকে ঢেকে নিচ্ছে  নদীপথ ক্লান্তি।
নদীপথ ফুরালেই আদিম অরণ্য কথা ...
গুহাচিত্রে পাথরে পাথরে  অজানিত দীর্ঘশ্বাস।
পরিযায়ী পাখীর ডানায়  ভেসে আসে শীত,
নিদারুন শৈত্যে নিসঙ্গতার ঢেউ ভাঙি
উষ্ণতা, একটু উষ্ণতার সন্ধানে...

তোমার - আমার মাঝের হাইফেনটাই মুছে যায়।