সোমবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৬

আল মামুন



আল মামুন
ভালবাসা এক পলক  
শেষ বিকাল
যখন সোনা রোদে পৃথিবী মায়াময়
পার্কের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলা যুবক
এক টুকরা কাগজ কুড়িয়ে পায়।
কেউ ঝালমুড়ি খেয়ে ফেলে গেছে-

শিউলি ফুলে সাদা হয়ে আছে পথের পাশে ফুটপাথ
শৈশবের দিন মাখামাখি হয়ে আছে শিউলির সাথে
হৃদয়ের পটে আঁকা
স্মৃতির ভিতর যত্নে রাখা।
রুপালী আলোর জালে যেন জড়ানো আঁধার-

ফুলগুলো সে মাড়িয়ে যেতে পারে না
না পা ফেলা যায়
পাশ কাটানো ও দায়
এমনই তার টান!
সে কুড়ানো কাগজে কুড়ানো শিউলি গুলি যত্নে তুলে নিলো-

হঠাৎ কী হয়
মৌসুম নয় তবু হাওয়ার ঝাপটা লেগে
কিছু ফুল পড়ে যায়
আবার তা তুলে নিতে হাত বাড়াতেই যুবক অবাক হয়।
সবুজ ঘাসের বুকে পড়ে আছে ফুলগুলি-

ওহ! কারো ওড়না! সভয়ে সে সরে এলো
আরক্ত মুখে এক তরুণী চকিতে ফুলসহ ওড়নাটা তুলে নিলো
অচেনা সবুজ ক্যানভাসে যুবকের চেনা শিশুবেলা নকশা হয়ে ফুটে রইলো
যতদূর চোখ যায় অপলক চেয়ে থাকে দৃষ্টি তার।
পথচারী মৃদু হাসে - 'যুবক বয়স!’-

ওড়না থেকে খসে তরুণীর হাতে এসে পড়ে দুটো ফুল
পিছু ফিরে ফুটপাথে তাকাতেই চোখে পড়ে যুবকের দু'চোখ আকুল!
এক মূহুর্ত তার ভুল হয় বহু দেখা লোভ ভেবে
ভুল ভাঙ্গে যুবকের হাতের কাগজে রাখা বাকী ফুল দেখে তবে।
ফিরে যায় তরুণী ফুল দুটো ঢেলে দেয় যুবকের হাতে, কাগজের বুকে-

জানে পৃথিবীতে জীবনেরই মত -ভালোবাসা এক পলকই
তাও তো কর্মফলে অমরত্ব পায়
শিউলির সাদা আর কমলায় অলখে বিকাল মিলায়
ভালোবাসা আছে দুটি প্রাণ নিরবে জানান দেয়।
তারপর,ফিরে যায় সেই পথে যেখানে যে যেতে চেয়েছিলো-

কে জানে! হয়তো প্রতিবেশীই হবে তারা
একই পথ, একই সবই হয়ত একই পাড়া
 শুধু পরিচয় হয় নি কখনো
আবার কভু হলে দেখা  জানা জানি ও হবে হয়তো।
 শিউলির স্মৃতিসূত্রে-
...


এখন দুঃসময়
একদিন এক কবি বলল
প্রতিটি মুক্ত শব্দই এক একটি কবিতা!
একজন বন্দী কবি কি
মুক্ত শব্দের স্রষ্টা হতে পারে?

মুক্ত স্বদেশে
এখন দুঃসময়!
এক একটি অক্ষর বলপয়েন্টের
প্রসবপথ থেকে বের হতেও ভয় পায়।
রুদ্ধ অনুভুতি হৃদয়ের ছায়ায়
দুঃস্বপ্নে আঁতকে ওঠে।

কবিতা এখন আর সৃষ্টিসুখের উল্লাসে
কাঁপায় না-
নিজেই খুঁজে ফেরে
শৃংখলিত এক একটি ব্ল্যাকহোল।।
...


ডিজিটাল ভালবাসা
ভালোবাসা যুগে যুগে নিজস্ব রূপে
পাড়ি দিয়েছে হৃদয়ের তেপান্তর
চলুন দেখে আসি আজ
কেমন ছিল ভালবাসার সেই যুগীয় রুপান্তর?

একটা সময় ছিল যখন কেউ ভালবাসার জন্য
'দুরন্ত ষাড়ের চোখে লাল রুমাল' বেঁধে দিতেও দ্বিধা করেনি।
'প্রেয়সীর জন্য 'বিশ্বসংসার তন্নতন্ন করে খুঁজে এনেছে ১০১ টি নীল পদ্ম'!
সেই ভালোবাসা এখন
ডিজিটাল যুগের ভার্চুয়াল জগতে এসে ধুঁকছে অবিরত!

আমাদের অ্যানালগ সময়ে
নীল খামে নীল কাগজে হৃদয়ের কথাগুলো
যরীন হরফে লেখা থাকত!
কুহকী প্রহর অণুক্ষণ উদ্বেগ উৎকন্ঠায় ভেসে ভেসে
পাশের বাড়ির সেই মেয়েটির ছবি
হৃদয়েই কেবলি আকত!

অব্যক্ত কথাগুলো প্রকাশের সেই দৃষ্টিভঙ্গি এখন
বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে!
বিনিদ্র রজনী জেগে জেগে প্রিয়াকে এখন
ভালবাসার পংক্তিগুলো আর লেখা হয় না
অনিশ্চযতার দুরু দুরু বুকের কাঁপুনি এখন
এসএমএস আর ইনবক্সে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে।

এখন আর বাড়ীর ছাদে কিংবা খোলা মাঠের
বিস্তীর্ণ ধানি ফসলের ভিতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে-
প্রেয়সীর খোঁপায় জড়ানো বেলী ফুলের তাজা নির্যাস
মনকে আকূল করার সময় পায় না।
চিঠি চালাচালির সেই উত্তেজনা এখন অ্যানালগ যুগের দামী এন্টিকস!
প্রেয়সীর বুকের সাথে সাময়িক মিশে থাকা সেই নীল খাম
প্রিয়ার পরিচিত সুবাস এখন আর বয়ে বেড়ায় না।

এখন মাংসল হৃদয়ের যান্ত্রিক কথাবার্তা
কী-বোর্ডের ইলেক্ট্রনিক ঘ্রাণকে সাথে নিয়ে স্কাইপের দ্বারস্থ!
কালো অক্ষরে হৃদয়ের লাল অনুভূতি এখন
ভালবাসার সিম্বোলিক কনভার্সনেই তৃপ্তির স্বাদ আস্বাদনে ব্যস্ত!
দামী রেস্টুরেন্টে উচ্চ কোলেষ্টরেল যুক্ত খাবার
আর দামী গিফট এর পিছনে নিরন্তর ছুটে চলে ডিজিটাল ভালবাসা।

প্রযুক্তি স্থানিক দূরত্বকে কমালেও
মনের দূরত্বকে বাড়িয়েছে
দু'জনের কাছে আসাটা আগে ছিল বড্ড কঠিন!
তবে মনের দূরত্ব ছিল না সেথায় একটুও।
এখন সহজে কাছে আসে হৃদয়গুলি
দুই মেরুতে অবস্থান ও নেয় পলকে।
মেকি সিম্বোলিক ভালবাসার ভিতর এখন প্রেয়সীর বুকের চাঁপা ফুলের ঘ্রাণ নেই!
সেখানে শুধুই যান্ত্রিক ঘ্রাণ আর ছলনার ইতিহাস।

এখন কবিগুরু ও নেই
ভালোবাসাও এখন তাঁর মতো ছন্দে ছান্দসিক নয়।
ভালোবাসা কি? এর উত্তরে বলেছিলেন তিনি-
"ভালবাসার কোন কথার
কি বা অর্থ-মানে?
ভালো যারা বেসেছিল
তারাই ভালো জানে"।
ভালোবাসা এখন যারা ভালোবাসেন তাঁদের নিজস্ব নিগুঢ় অর্থে দীপ্তমান!
বহুরূপী ছদ্মবেশী ডিজিটাল ভালবাসা
নিরন্তর পোড়াতে জানে কেবলি
জাগায় না কোনও আশা!
এখন.. কেবলি মিথ্যে এ ভালবাসা।।

...

শেষ তৈলচিত্র
সাদাকালো অরণ্য- পাহাড়- নদী পার হয়ে
মরুর ধুলো উড়িয়ে দুরন্ত ছুটে চলা ভাবনার
লাগামহীন এক পাগলাঘোড়ায় সওয়ার হয়ে
নিশ্চুপ বসে আছি।

দুর্দান্ত গতিময় স্বপ্ন - স্থবির বাস্তব - অর্থহীন -সম্ভাবনাহীন।
অথবা কি সম্ভাবনাময়?
কী রং তাদের?
.
এক হঠাৎ বর্ণান্ধ শিল্পী।
যা কিছুই আঁকি - যে রং এ আঁকি - কিছুই দেখিনা।
আঁকার অসহ্য তাড়না ছবির পর ছবি আঁকিয়ে নেয় আমাকে দিয়ে।
অথচ নিজেই দেখিনা কী আঁকি!
.
জীবনের ক্যানভাসে আঁকা ছবিটায় ও কোন রং নেই।
ছবি জুড়ে শুন্যতা। শুন্যতা যেন হঠাৎ সারা পৃথিবীতে।
অনুভূতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে -
"আমি একা! বড্ড একা!"

আমাকে নি:সংগ করে রং গুলো সব
বারান্দার চড়ুইগুলির মতো পালিয়েছে।
.
আমার আকাশে ইচ্ছে ঘুড়িগুলোর কোনো রঙ নেই।
আকাশটা জানি নীল।
সেখানে কষ্টের বিষাক্ত নীলাভ আভা নিয়ে
দুঃখগুলো সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়ায়।

জানি পৃথিবী রঙে রঙে ভরা।
হরেক রঙের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি- বর্নান্ধ শিল্পী।
.
যে দূরে চলে গেছে, তবু এত কাছে,
তবু দূরে - অন্য কারো।
তার মুখ ক্যানভাসে আঁকি।
শেষ তৈলচিত্রে আঁকি
হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা - ভালো লাগা দিয়ে সেই হাসিমুখ।

এ কি ভালোবাসা! এ কি ভালোলাগা!
কেন অনুভুতি বলে না আমাকে!
তীব্র কষ্ট যেন হিমাংকের বহু নিচে নিয়ে যায় আংগুলগুলোকে।

তুলি এঁকে যায়।
সে কি ভুল রেখা ভুল রঙে আনন্দ আঁকে!
.
দিশেহারা লাগে।
আনন্দ নেই!
ক্যানভাসে শুধুই সাদাকালো কষ্টের ছাপ - তার মুখচ্ছবি!
একজন রঙ বিশেষজ্ঞের জীবনের শেষ ছবিটি - অজানা রঙে আঁকা।
.
অতিপরিচিত একদার আনন্দে উদ্ভাসিত হাসিমুখ
সে আজ কষ্টের তীব্রতায় বিবর্ণ, পাংশুটে।
রং নেই। রেখাগুলি কথা শুনবে না!

ক্যানভাসে আঁকি যেন তার কষ্টভরা মুখ নয়,
এক অহংকারী শিল্পীর ব্যর্থতার ছবি!
মূর্ত উপহাস!
...


সব ফিরিয়ে দিলাম
সেদিন অফিস বন্ধ ছিল আমার
সকাল থেকেই তুমুল বৃষ্টি
এমন দিনে মতিঝিল থেকে ফিরছিলাম সাভারের বাসায়।
.
বিআরটিসি'র ডাবলডেকার বাসের
দোতলার কয়েকটা জানালায় কাঁচ ছিল না
উপরে তাই যাত্রী ও ছিল কম
নাই বললেই চলত.. আমি একাই ছিলাম শুধু।
ভেজা সিটে বসতে অনীহায় নীচতলায় অনেক গাদাগাদি
তাই দেখে
দোতলায় ভাঙ্গা জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখে দেখে ভিজে চলেছিলাম।
বৃষ্টি দেখছিলাম
আর অনুভব করছিলাম বিষন্নতা।
.
সে আমার থেকে বছর দশের ছোট হবে
পেটা শরীর আর চোখ দুটি নজর কাড়ে
ঘষা কাচের মাঝে সাপের শীতল দৃষ্টি!
এত জায়গা থাকতে আমার সাথের সিটেই বসে স্বগতোক্তি
' কথা বলা ছাড়া জার্ণি বোরিং লাগে
তাই পাশেই বসলাম।'
.
ঘুরে ওর দিকে তাকাই এক পলক
চোখ সরিয়ে বাইরের বৃষ্টিতে মন ধুয়ে নিয়ে বলি
'আমাকে বেশ আলাপী লোক বলে মনে হল আপনার?'
নিরবে হেসে সাদা রুমাল দিয়ে
মাথা আর মুখ মুছে সে
উত্তর দেয় না।
.
হয়ত হাসি-ই উত্তর ছিল তার
আমার দেখার গরজ ছিল না
তাই নিরব থাকার চেষ্টা করি।

ফার্মগেট পার হলেও আর কেউ ওপরে এলো না
এমন ঘন ঘোর বরষায় বৃষ্টির ছোয়ায় থাকে ভেজবার ব্যকুলতা!
কিন্তু বেশীরভাগই ঘরকুনো মানুষ
তাই নির্জন নিশ্চুপ চারিধার ।
.
সিগ্রেট ধরিয়ে এক মুখ নিকোটিন বাতাসে ছড়ায়
আর হেসে বলে ' মাফ করবেন, পারছিলাম না থাকতে আর'
হাসি সংক্রামক
আমাকেও আক্রমন করে।
.
আসাদ গেট আসতেই টুকটাক অনেক কথা
এক পর্যায়ে সে বলে আমার এক প্রশ্নের উত্তরে,
' আমি পেশাদার খুনী.. এক পতিতার ছেলে।'
আজ স্পষ্ট মনে নেই তার কথা শুনে
পলকের তরে থমকে গিয়েছিলাম কি না?
ওর পলকহীন সাপের চোখে
ঐ মুহুর্তে আমি পলক পড়তে দেখলাম!
নিষ্প্রাণ ঘষা কাঁচ ভেদ করে
প্রাণের উন্মেষ অনুভব করলাম!
.
'আমার মাকে তার এক প্রেমিক
গ্রাম থেকে এনে পাড়ায় বিক্রী করে দিয়েছিল।
আপনার মত কোনো এক ভদ্রলোক হয়ত আমার বাবা!
পলাতক চাঁদের মত তিনি
অনুভবে আছেন কিন্তু ধরা-ছোঁয়ার বাইরে!
হয়তো অনেকেই আমার বাবা।'
.
'মাকে এক মাতাল খদ্দের ক্ষুর দিয়ে গলা কেটে মারল যেদিন
আমি তখন কতটুকুই আর
সব স্পষ্ট মনে নেই আজ।
তবে এরপর বড় হবার জন্য
আমাকে যা যা করতে হয়েছে সইতে হয়েছে..
থাক সে সব কথা।

প্রথমে পাড়ার প্রতিবাদী টোকাই
সময়ের সাথে সাথে বেড়ে উঠে
বড় ভাইদের নজরে পড়ে ক্ষুদে মাস্তান
এরপর ভাইয়ের ডান-বাম উভয় হাত!
ভাইকে সিঁড়ি বানিয়ে আরো উপরে উঠবার চেষ্টা...
সফল হল.. ব্যর্থতা ও এলো
তবে সেটা কেবল শিক্ষার অভাবে।
কিন্তু জীবন জন্ম থেকে যা শিখালো
তা ও একেবারে কম ছিল না।
.
এক 'মহামান্যের' একটা কাজ করতে গিয়েই প্রথম রক্তের স্বাদ পেলাম!
বাঘ হলাম
আর একবার বাঘ হলে
কখনো আর শিয়ালের জীবনযাপন করা যায় না!
তাই বাঘ-ই রইলাম
টাকার বিনিময়ে শিকার করতে লাগলাম।
.
আমার অতীত জুড়ে অন্ধকার
তাই চাইলেও আমি আলোয় যেতে পারিনি!
কখনো যে আলো হতে চায়নি মন তা ও বলব না
চেয়েছে!
কিন্তু জন্মই আজন্ম পাপ যার
আপনাদের সিভিল সোসাইটি তো তাকে বাঁকা চোখে দেখবেই!

আমাকে আপনাদের কবিরা বলেন
'অন্ধকারের নারীর সন্তান!'
আরে!
অন্ধকারে নারীকে টেনে নিয়ে যান আপনারা-ই
আপনাদের ভেতরটা-ই তো
নিকশ কালো!
পুরুষের গোপনাঙ্গের ঘন লোমরাজির মত কালো!
আর আমাকেই বলেন কিনা অন্ধকার কক্ষে পতিতার গর্ভে
জন্ম নেয়া এক কুলাংগার সন্তান?'
.
আমি কোনো উত্তর দেই নাই তার কথার
বিবশ হয়ে ভাবছিলাম শুধু!
সে ও চুপ চাপ..
সিগ্রেট নি:শব্দে জ্বলছে.. পুড়ছে
আমাদের দু'জনের হৃদয় ও।

আমি বিশমাইল গেইটে নেমে যাচ্ছি
ওপর থেকে সে পলকহীন ঘষা কাঁচের চোখে তাকানো
আমাকে বলল, 'এই যে মিস্টার
তোমার নামটা জানা হল না কিন্তু?'
আমাকে অবাক হতে দেখে হাসে সে
'তুমি করে বলছি বলে অবাক হচ্ছ বেশ!
যে কথা কখনো কাউকে বলিনি আজ বলছি তোমায় শোনো
তোমরা-ই কুলাংগার অন্ধকার
তোমরাই মাগি বেশ্যা পতিতা
পতিত সময়ের নরকের কীট!
এগুলো-ই বলতে না আমার মাকে?
যা যা বলতে তাকে
আজ সেগুলি-ই সব তোমাদের ফিরিয়ে দিলাম।।'