রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

দেবাশীষ অন্যদিন


আঁতাত
দেবাশীষ অন্যদিন
তানহা তানহা মাত সোচা কর, মার জায়েগা, মাত সোচা কর
- মেহেদী হাসান

ফুলের জায়গা নেবে প্ল্যার্কাড, ফেস্টুন।
সোনামুগরাঙ্গা বিকেলের মৃত্যু হবে একদিন,
বাজারি ড্রইং থেকে চিমটি কাটা রঙ একে একে নিলাম হবে;
সাম্য-আলবেলা ফ্রীজ হয়ে
যাবে কাঁটাগাছের অভিমানী গানে, আর পরিশ্রমী গাইতির ডগায়।
সোমত্থ পুরুষরে বুকের
পাটাতনে খসে পড়বে যত ছাপ্পান্ন ওমের ওড়না,
প্রতিটি জরুরি অনুভুতির ভেতর লেখা
হবে না একটি করে নক্ষত্র পতনের ইতিহাস।

শামুক চিনে ফেলবে জাইলেম, রেণুর বেদনা সইতে পারবেনা কীট,
বুকের ভাঁজে ভাঁজে
রাখবেনা কেউ গুপ্ত পঙতিমালা।

সুতরাং,
সুনীল পাবে না নিরার ছোঁয়া,
চিনিচাপার রঙ ভুলে যাবে জীবনানন্দ দাশ

কবিতা হবে না আর, মিলিয়ে নিও,
মিলিয়ে নিও

এদেশে এসবের নামই হবে উন্নয়ন।






হাঁটছি
পাখির সঙ্গে কয়েক পা
দেবাশীষ অন্যদিন
দুপুর একটা তেত্রিশেরও কখনো মন খারাপ হয়
মন খারাপের রোদ ত্বকের গভীরে পৌঁছে নাচে
'পুং ছলম'
খোলের তালে তালে প্রাণ রস খুঁটে খুঁটে খায়, ইচ্ছেরা
লোমকূপে ততক্ষণে কুণ্ডলী পাকিয়ে দাহ
তার
পর
সমস্ত সম্ভাবনাকে ফাঁকা করে সান্দ্র বিষাদ গড়িয়ে দেয়

হুম, ফাঁকা
ঠিক আমার কবিতার মতো

বারোটা পঁয়তাল্লিশকে আমি প্রায়ই ডেকে বলি
ওল্টানোর আগে সাবধান, বিরোধিতারা ছুঁয়ে ফেলতে পারে
আঁকিবুকির জটিলতা, এমন হলে বিস্মরণ ঘটে যাবার
সমূহ সম্ভাবনা

চাপ চাপ আঁধারে আলো বোধ নিয়ে উল্টে যায় যদি কারও
চিবুকের জোয়ার, চারিদিকে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাবে 'মেঘলা আকাশ'
একটা রোগের নাম, রোদ গলে যাবে তখন দামাল চোখে

সর্বনাশ

ঝাপসা ভাষায় অনুবাদ হলে তুমি পড়বে কি করে, বলো বলো

আজ দুপুর একটা তিরিশ নিয়ে এসেছে মেঘলা এপিসোড
চোখের জল ছাড়া এসমস্ত কষ্টের আর কি কি অভিব্যক্তি আছে
এই মুহূর্তে এটা নিয়ে কোথাও রিসার্চ করছে কি কেউ

আচ্ছা মূল প্রসঙ্গে আসি
চাক ভাঙ্গা নদী মুঠো খোলে, শুরু হয় ছোঁয়াচে আলাপ
ঘরে থাকে হারানো স্বজন, ব্রিজ পেরোলে কুমারী বাঁক

মেঘ ভাসে,  কার্নিশে

এই যে ঝুল বারান্দা তার উপরে মেঘ, তারও

এক
লাফ
উপরে

গোটা একটা জীবন অভিমান খুঁড়ছে, সেই
অজুহাতে পোশাক খুলতে খুলতে যাদুকরের মত
বৃষ্টি নামাচ্ছে মেঘ

ইদানীং
জানালার হুকে ঝুলে থেকে আমি এই সমস্ত দেখতে পাই
অল্প অল্প করে ডানার ভাষা শিখছি,
অযথা ঝাপসা রঙের প্রচুর প্রশ্ন
তোমার মনে, পাখিরা এসব এড়িয়ে যায়, পাখিদেরও জ্বর হয়
কবিতা পড়ে

এতোটা হেসো না উড়াল






সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ ধুমপান মৃত্যু ঘটায়
দেবাশীষ অন্যদিন
“Stars, hide your fires; Let not light see my black and deep desires.”
William Shakespear, Macbeth

মানুষের ছদ্মবেশে থাকি, আমৃত্যু কুয়াশাতে ঢাকা এক পাখি,
স্বপ্নের ধ্রুবকথা বলি প্রলুব্ধ আমাকেই ইনিয়ে বিনিয়ে,
যদিও উড়ে যাওয়াই আমার স্বভাব।

চাহনিতে আছে পিনড্রপ সাইলেন্স টাইপ কিছু,
এমন মেয়ের চোখের দিকে
নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে
খুব স্লো-মোশানে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে
প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় লম্বা টানের পর
আলতো টুসকিতে ছুঁড়ে ফেলে
নাকে মুখে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে
গাঢ় স্বরে বলতে ইচ্ছে হয় -

চল সমুদ্রে যাই,
সাথে নাও সানগ্লাস, কলঙ্ককূলের সাথে ভাসবে দেহ, পারবে এতোটা?






রূপাগ্রস্থতা
দেবাশীষ অন্যদিন

সাঁকোর গল্প পুরনো হয়েছে বহুকাল, বিলুপ্ত স্মৃতি কামড়ে রয়েছি তবু। রূপা পেরিয়ে গিয়েছে বহুবার, শেষবারে ফেরেনি, শুধু যাবার গল্পের রেশ রয়ে গেছে। নেই সাঁকোটার কাছাকাছি এখন চৌরাস্তা, নাভি থেকে পথ এঁকে বেকে গ্যাছে, আরেকটু এগুলেই গোল পাহাড়, জিলিপি পাহাড়, খুলশি, কাজীর দেউরী, ওড়না লেইন, পাঞ্জাবী গলি। অথচ চৌরাস্তা ধরে আমি যতবার এগুই আমার সমস্ত পথ নেই সাঁকোটার কাছে চলে আসে। ওটা রূপার ছিল হয়তো কোনকালে, আমি স্রেফ অতিথি, কখনো নিমন্ত্রণে চোরা রোদের ওপিঠে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে গড়ানোর ভঙ্গিতে আমরা কথা বসাতাম। রূপা জানেনা, রূপাতো নির্ঘাত জানেনা কোজাগরী রাতে মধ্যবর্তী সেতুতে দাঁড়িয়ে তার অপেক্ষায়, একজন ফিকে মানুষ, এখনো।

রূপাদের বাড়ির ছবি আমার ক্যালেন্ডারে চাপা পড়ে আছে। বর্গী-পাড়ায় জন্ম যেহেতু আমার কেবলই ছিনিয়ে নেবার লোভ, যতবার ও বাড়ি গেছি ততবার সোনাঝুড়ির সিঁড়ি ভেঙ্গে আমি টপকে গেছি তৃষ্ণার্ত বেপাত্তা কিছু স্মৃতি, বিনিময় প্রথা। একবার দেখিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছে, আমার দিকে নয়, একুরিয়ামের সদ্য অতিথি গোল্ডফিসটার দিকে, যদিও ওই বন্দি মাছটার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, তবু বর্গী যেহেতু আমি তাই পুনরায় ছক পেতে বসি, মাছটা কিছু বুঝতে পেরেছিল কিনা জানিনা, শুধু দেখেছি রূপার পাশে দাঁড়ালেই সে লেজ নাড়িয়ে একুরিয়ামের গভীরে চলে যেতো।  তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম রূপার চুলের দিকে, এমন আঁধার আমি জীবনে দেখিনি।

ওর সাথে বেড়াতে গিয়ে একদিন পাঁচ টাকার কয়েন ফেলেছিলাম যন্ত্রে, ভবিষ্যৎ ছাপা হয়েছিল ছোট্ট কাগজের টুকরোয়অর্জুন তুমি, পাবেই দ্রৌপদীর ভালবাসা, কুরুক্ষেত্র থেমে গেলে। পড়ে, ঝর্না গলায় হেসেছিল রূপা।  ঝর্নার ওই জল কি কেবলই জল, মাথার ওপরে এই যে আকাশ, সে কি আকাশের চাইতেও বেশি নয়! আমরা কেউ তখনো ততখানি নিসর্গ-শিকারি ছিলাম না, নতুবা আমার সব সমর্পণ, সব প্রতিবাদ, আধখানা জ্বরে পুড়ে যেতো। এখনো জানতে পারিনি আমাকে জরীপ করে কি পেয়েছিল রূপা। প্রস্তুতিবিহীন বিপন্নতা?

গভীর আয়নার সামনে অনাদিকাল একটা মেঘের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, এখন আর আমার মধ্যে কোন কিন্তু নেই, অথচ মৃত্যুর অধিক তৃষ্ণা বুকে, মনে পরলে ব্যস্ত সময় এক লহমায় পিছিয়ে হপ্তা, মাস, বছর হিসেব নেই। চুমুর চেয়েও ঘনিষ্ঠ কিছু কি ছিল তোমার বিদায় সন্ধ্যাবেলা? অতটা দহন কি করে সহ্য করে আছি! আমার পতন-প্রবণ মন, আমার বুকের পাটাতন, লুকিয়ে রেখেছে বিষাদের ইন্সটলেশনগুলো। রাত জাগি, জুয়াড়ির মত ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়ে, যন্ত্রণার চড়াই শরীর বেয়ে ওঠে, আমি ইতিহাস হাতড়ে কুহুভর্তি গেলাস খুঁজি। জানালা গলে হুমড়ি খায় বেগম আখতারজোছনা করেছে আড়ি...

আজ যখন নিঃসঙ্গতার কথা ভাবছিলাম, নাটকীয়ভাবে বিদ্যুৎ চমকায়নি আকাশে। আমার কাছে রেখে যাওয়া রূপার সেই গোল্ডফিস আমাকে দেখতে পেয়ে তিনবার লেজ নাড়িয়েছিল। তাকে আমি রোজ খাবার দেই, স্নান করাই। তবু তার প্রতি বিদ্বেষ বেড়েছে, সে পুরনো বন্ধুকে ভুলে গ্যাছে খুব সহজেই, অথচ তার এবং আমার জয়েন্ট বুক ক্ষত বিক্ষত ছিল। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে, যে কথা রূপাকে বলিনি কখনো, গোল্ডফিস জানে। তার মৌন ভাষা আমি শুনতে পাই, বলে, শরীরও ভালবাসা, ভালবাসা উত্তাপ, তাকে যৌনতা বলা নিতান্তই অপরাধ বরং এসো কিছুদিন খুব কাছাকাছি থাকি।

করোটির শাঁসভূক গ্রন্থগুলো গড়াতে চাইছে জলে, হে ঈশ্বর যদি প্রেম দিলেনা প্রানে, তবে কেন খাঁচা দিলে বাঁধিবার। যদি ফিরে এসো এ শহরে কোন সন্ধ্যায়, যদি দেখ আকাশের গায়ে ভ্রুকুটির মত চাঁদ, আর সাঁকোতে দাঁড়িয়ে একটা ভাঙ্গা শরীর হৃদয়ের কাছে ক্ষমা চাইছে, রূপা তুমি চমকে যেওনা।