রবিবার, ২১ জুলাই, ২০১৯

সম্পাদকের কলমে



কবিতা মূলত সময়েরই অভিজ্ঞান

নেমেছে বৃষ্টি। ঝরছে জল। কাটছে গরম। ধরণীতল। অবশেষে আষাঢ়ের হাত ধরে বাংলায় বর্ষা ঢুকেছে। প্রচণ্ড দাবদাহ আর নাই। বৃষ্টিভেজা বাতাসের ছাঁট মাঝে মধ্যেই মন ভালো করে দিয়ে যাচ্ছে। মানুষ এবার একটু শান্তির আশায় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে পর্যাপ্ত ফসলের। কিন্তু সে তো মানুষের স্বপ্ন। মানুষের আশা। মানুষই তো শেষ কথা নয় এই বাংলায়। এখানে শেষ কথা রাজনীতি। সেই ঠিক করে দেয় কেমন থাকবে মানুষ। কোন দিকে চলবে সমাজ। সেই রাজনীতির পরিমণ্ডল কিন্তু এখনো উত্তপ্ত। প্রবল ভাবেই। প্রতিদিনই রাজনীতি ছিনিয়ে নিচ্ছে আস্ত আস্ত মানুষের জলজ্যান্ত প্রাণ। নিভে যাচ্ছে তরতাজা মানুষগুলি একে একে। তাতে আমাদের মত সাতে পাঁচে না থাকা সাধারণ জনগণের কিছু এসে যায় না। মারা যাচ্ছে রাজনৈতিক দলের নীচুতলার কর্মী সমর্থকরাই তো। কিংবা রাজনৈতিক দুস্কৃতিরা। বরং রাজনৈতিক দলগুলির এতেই পৌষমাস। যত লাশ তত উল্লাস। লাসের রাজনীতিই ক্ষমতায় উঠে আসার অন্যতম সহজ সোপান। আবার সেই লাশের রাজনীতিই ক্ষমতা ধরে রাখারও অন্যতম আয়ুধ। শুধু ঠিকমত খেলতে পারলেই হলো। যুযুধান গোষ্ঠীগুলি সেই খেলাতেই মত্ত। আর তাই উন্মত্ত কর্মীসমর্থকদের দাপটে হয় জয়শ্রীরাম না বললেই গনধোলাইয়ে মৃত্যু। নাহলে বললেও গণধোলাইয়ে মৃত্যু। দুপক্ষই গণধোলাইয়ে সিধ্বহস্ত। মাঝখানে বিভ্রান্ত ব্যক্তি মানুষ। কি অদ্ভুত শক্তি এই জয়শ্রীরাম ধ্বনিতে। হাসতে হাসতে মানুষ পিটিয়ে খুন করা যায়। উন্মত্ত খুনের উল্লাসে মুহূর্মুহ জয়শ্রীরামে প্রকম্পিত করা যায় আকাশ বাতাস। ভয় ধরিয়ে দেওয়া যায় বিরুদ্ধ গোষ্ঠী কিংবা অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে। আবার লাশের রাজনীতির খেলায় সেই একই জয়শ্রীরাম ধ্বনি ন্যায় বিচারের দাবিতে সরব হয়ে পথরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সেও রাজনীতিরই স্বার্থে। জয়শ্রীরামের রাজনৈতিক তাৎপর্য তাই আর অস্বীকার করার উপায় নাই এই বাংলায়। খুন জখম লুঠতরাজ বোমাবাজিতেও জয়শ্রীরাম আবার বিচারের দাবি নিয়ে ধর্ণায় বসতেও জয়শ্রীরাম। জয়শ্রীরামের মোকাবিলায় আবার জয়বাংলা কিংবা জয়হিন্দ। ফলে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল ও পুনর্দখলের লড়াইয়ে জয়ধ্বনির জয়জয়াকার।

কিন্তু সেই জয়ধ্বনি কার স্বার্থে? রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার স্বার্থেই তো। সেখানে সাধারণ জনগণের স্বার্থ কোথায়। না জনগণের কোন স্বার্থই নাই। আর সেইকথা সবচেয়ে ভালো জানে জনগণই। ভালো জানি আমরা। তাই আমরা বিশেষ করে যারা সাতেও নাই পাঁচেও নাই, তাদের এইসব নিয়ে মাথাব্যাথাও নাই কোন। সেই কারণেই আমাদের গলা দিয়ে দুইবেলা দিব্যি মাছভাত গলে যায়। সারাদিনের পরিশ্রমের শেষে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে দিব্যি প্রেমের কবিতাও লিখি ফেলতে পারি নিয়মিত অম্লানবদনে। না আমরা সাতেও নাই পাঁচেও নাই। রাজনীতি চলবে রাজনীতির পথে। আমরা চলবো আমাদের পথে। অসুবিধা কি? তাই কবিতা পত্রে কবিতার কোন অভাব হয় না। আমাদের কবিতা পড়ে এই সময়ের চালচিত্রেরও হদিশ পাওয়া যায় না কোন। এই সময়কে ধারণ করে যে সাহিত্যচর্চা, না সেই বিষয়ে আমরা সকলেই কম বেশি উদাসীন। আমরা মনে করি, কবিতা একটি শাশ্বত বিষয়। স্থান কাল পাত্রের উর্ধে। তাতে সময়ের মালিন্য বা পরিস্থিতির কালিমা লাগা উচিত নয় কখনোই। কবিতা চিরকালীন মানবতার কথা বলবে। শাশ্বত মূল্যবোধের দীক্ষায় আলো দেখাবে ভবিষ্যতের মানুষকে। এমনটাই ভাবি আমরা অধিকাংশই। তাই আমাদের কবিতা এইসময়ে লেখা হলেও কোনভাবেই এইসময়ের প্রভাবে প্রভাবিত হয় না। এখানেই এইসময়ের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট।

কিন্তু এমনটা হওয়াই কি ঠিক ছিল? এমনটা হওয়াই কি উচিৎ? যে কবিতা তার সময়ের বেদনাকে ধারণ করতে সক্ষম নয়, সেই কবিতা কি শাশ্বত জীবনবেদর সার্থক রূপকার হয়ে উঠতে সক্ষম আদৌ? অনেকেই বলবেন, সময়েই শেষ কথা বলবে। অত্যন্ত মূল্যবান পর্যবেক্ষণ। সময়ই শেষ কথা বলে। কিন্তু আমরা যদি একটু পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি। ইতিহাসের পাতা উলটাই। তাহলে কি এইরমকই প্রতিচ্ছবি দেখি? না কি সেখানে অন্যতর প্রতিচ্ছবি দেখা যায়? ভেবে দেখতে হবে আমাদের সেটিও।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে দুকলম লিখলেই কবিতা হয় না ঠিক। ঠিক তেমনই সমসাময়িক সময়ের অসুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে শাশ্বত প্রেমের কবিতা লিখতে চেষ্টা করলেও তা কবিতা হয়ে ওঠে না কোনভাবেই। এইখানেই আমাদের একটু থেমে যথেষ্ট সময় দিয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে; আমরা তাহলে এগবো কোন পথে। না, সকলের অভিমুখ নিশ্চয় একদিকেই হবে না। সেটি হওয়া কাম্যও নয় কোনভাবেই। কবিতা মূলত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞান। তাই আমরা গোষ্ঠীবদ্ধ সমষ্টিগত কবিতা লেখার দিকে ইঙ্গিত করতে চাইছি না আদৌ। কিন্তু আজকের কবি, তিনি কিভাবে সমন্বয় করবেন এই সময়ের অসুখের সাথে তাঁর কবিসত্ত্বার অন্তহীন দিগন্তের? এই সময়ের বেদনা ও তার স্বপ্নকে ধারণ করেই কিভাবে লিখবেন শাশ্বত মূল্যবোধের কবিতা? কেননা তাঁকে উপলব্ধি করতে হবে, তাঁর সময়ের বেদনা ও স্বপ্নকে আস্বীকার করে শাশ্বত মূল্যবোধে পৌঁছানোর কোন পথই সম্ভব নয় বাস্তবে। আমাদের বিশ্বাস সাহিত্যের ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীরা বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবেন সঠিক ভাবে। সহজেই। আজকের কবি ও কবিতাকে পরিষ্কার বুঝে নিতে হবে এই সত্যের সারৎসার।

আমাদের আকাঙ্ক্ষা, আজ যাঁরা নিয়মিত কবিতা লিখছেন ও লিখবেন সামনের দিনগুলিতে তাঁরা ঠিক এই প্রশ্নগুলিই রাখবেন নিজ নিজ আয়নার সামনের দাঁড়িয়ে। এবং খুঁজতে স্বচেষ্ট হবেন উত্তরগুলি একান্ত আন্তরিকতায়। আমাদের আশা, তাহলেই বর্তমান বাংলা কবিতা একটি মূল্যবান বাঁকের মুখে গিয়ে পৌঁছাতে সক্ষম হবে যথার্থভাবেই।

কবিতা কিংবা সাহিত্য কিন্তু মূলত সময়েরই অভিজ্ঞান। সময়কে পাশ কাটিয়ে সাহিত্যচর্চা অসম্ভব। তা মূলত শব্দ নিয়ে খেলা করা। এক ধরণের ভাঁড়ামো। কিন্তু আমাদের রাজনীতি, তার কলুষতা, নেতানেত্রীদের অসাধুতা উদগ্র ক্ষমতালিপ্সা এবং সর্বপরি সমাজের সার্বিক অবক্ষয় আমাদেরকে বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে। আর তাই আমরা সময়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে শাশ্বত কবিতা লেখার ভান করছি মাত্র। আমাদের অবচেতন মনে এই নিয়ে নিরন্তর দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলছে, যা আমরা বুঝতে পারি না অধিকাংশ সময়েই। যেকারণেই আমাদের যাবতীয় অসহিষ্ণুতা। আমাদের বুঝতে হবে, এই সময়কে পাশ কাটিয়ে নয়, এই সময়ের যাবতীয় অসংলগ্নতাকে প্রতিরোধ করতেই আমাদেরকে শাশ্বত সময়ের অভিজ্ঞানের কাছে পৌঁছাতে হবে দীক্ষা নেওয়ার জন্য। সেখানেই আমাদের মূল দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব এড়িয়ে আর যাই হোক প্রকৃত কাব্যচর্চা অসম্ভব।

আমরা জানি না, সেই দায়িত্ব রক্ষায় মাসিক ওয়েবপত্র কবিতাউৎসব কতটা সফল বা বিফল, সেকথা বলবেন আমাদের পাঠকবর্গ। তবে সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে স্বীকার করতে দ্বিধা নাই, সেই বিষয়ে আমরা নিজেরাই সন্দিহান আজো। যদিও একথাও ঠিক, কবিতাউৎসবে প্রকাশিত কবিতা সংশ্লিষ্ট কবির একান্ত আপন সৃষ্টি। সে বিষয়ে কবিতাউৎসবের কোন দিকনির্দেশনা থাকে না। কারণ আমরা স্রষ্টার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তবুও আশা করতে ইচ্ছা হয়, কবিতাউৎসব দিনে দিনে প্রকৃত সাহিত্যচর্চার দিগন্ত হয়ে উঠুক। এবং আলো ছড়াক চতুর্দিকে। যেখানে কবিতা আত্মপ্রকাশ করবে সময়ের অভিজ্ঞান রূপে। শখের কাব্যচর্চার সময়কাটানোর কোন মাধ্যম হিসাবে নয়।

সেই আশা নিয়েই আমাদের পথ চলা। যে পথে আষাঢ় পেড়িয়ে আবারো আর এক শ্রাবণ এলো ঐ। কিন্তু এই সংখ্যার বিষয়ে সম্পাদক হিসাবে দুটি অসন্তুষ্টি রয়েই গেল। এক, এবারের অধিকাংশ মনোনীত কবিতার মান নিয়ে যথেষ্ঠই প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে। আমরা অত্যন্ত হতাশ এই কারণেই যে এই সংখ্যায় যথেষ্ঠ সংখ্যায় মানসমম্মত কবিতা প্রকাশ করা সম্ভব হয় নি। অনেকেই এই বিষয়ে সম্যক সচেতন নন। অধিকাংশই ভাবেন তাঁর সব লেখাই কবিতা। কিন্তু তা কিন্ত নয়। কারুরই সব লেখা কবিতা হয়ে ওঠে না। স্বয়ং রবিঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, এমন কি জীবনানন্দেরও নয়। তাই কবিতাউৎসবের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে বিনীত অনুরোধ, কবিতাউৎসবে সেই সেই কবিতাই পাঠান, যে কবিতা পড়ে আপনার কবিকৃতির বিষয়ে অধিকাংশের মনে কোন প্রশ্নচিহ্ন দেখা না দেয়। তাতে আপনার কবি পরিচিতিই সুরভি ছড়াবে বেশি করে। এবং দ্বিতীয় যে অসন্তুষ্টি রয়ে গেল, সেটি হল; স্থানাভাবে নির্দিষ্ট সময়ের ভিতরে আসা সত্তেও অনেকেরই কবিতা আমরা এই সংখ্যায় গ্রহণ করতে পারলাম নাতাই সকলকেই অনুরোধ, কবিতা পাঠানোর শেষদিনের অপেক্ষায় বসে না থেকে তাড়াতাড়ি কবিতা পাঠিয়ে দিলে সেই সংখ্যায় প্রকাশের সম্ভাবনা বেশি থাকে। যদিও যাঁদের কবিতা কোন একটি সংখ্যায় সময় মতো আসা সত্তেও প্রকাশ করা সম্ভব হয় না, তাঁদের সেই কবিতাগুলি মনোনয়ন সাপেক্ষে পরবর্তী সংখ্যায় অবশ্যই প্রকাশিত হয়। হয়ে থাকে, এবং নিশ্চয় হবে।