রবিবার, ২১ মে, ২০১৭

চয়ন ভৌমিক




কবিতাউৎসব সাক্ষাৎকার  

কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। কবিতা আর বাঙালি: বাঙালি আর উৎসবএ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে, এই নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশই থাকে না। আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি। কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতায় থাকতে ভালোবাসি। আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা। তাই কবিতা নিয়ে বাঙালির এই উৎসবকেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব, শুধুমাত্র কবিতার জন্যে কবিদের মাসিক পত্র। বাংলার জনজীবনে কবিতার এই যে একটা বিপুল প্রভাব এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করে।

চয়ন ভৌমিক: শুভ্রবাবু প্রথমেই আমার ধন্যবাদ আপনাকে। আমাকে কবিতা উৎসবের মত কবিতামনস্ক এক বহুপঠিত পত্রিকায় যুক্ত করার জন্য। সত্যি কথা বলতে কী, এই যে বাংলার জনজীবনে কবিতার প্রভাব – এই প্রভাবেই কবিতা পড়া শুরু আর তার রস আস্বাদন ছোটোবেলা থেকেই। ছোটোবেলার কবিতা অবশ্য সীমাবদ্ধ ছিল রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত অথবা সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কিংবা সুকুমার রায়’এ আর তারপর কলেজে প্রবেশ করে কবিতার বিশাল সমুদ্রে ভেসে গেলাম যেন। সেই প্রভাবে প্রথমে পড়া আর তারপর লেখা। আসলে কবিতা এমন একটা সৃষ্টি যেখানে নির্মাণের কোনো স্থান নেই, পুরোটাই খুব সত্যি আর মানুষের, সমাজের নিজেদের প্রকাশ করার মাধ্যম। এটাই প্রভাবিত করেছে আমাকে বলতে পারেন।



কবিতাউৎসব: কিন্তু বাঙালির প্রতিদিনের জীবনে কাব্যসাহিত্যের ঐতিহ্য কতটা প্রাসঙ্গিক কতটা হুজুগ সর্বস্ব বলে আপনি মনে করেন? অর্থাৎ জানতে চাইছি জাতি হিসেবে সাহিত্যের সাথে আমাদের আত্মিক যোগ কতটা গভীর। নাকি আসলেই এটি একটি সামাজিক হুজুগ, সামাজিক পরিচিতি লাভের সহজ একটি উপায় হিসাবে।

চয়ন ভৌমিক: কম বেশী সাহিত্যের সাথে কিন্তু আমাদের সবারই যোগ রয়েছে। সে সাহিত্য আপনি লিখিত সাহিত্য বলতে পারেন বা কথিত সাহিত্য। আসলে সাহিত্য তো খালি বাঙালি নয় সমগ্র বিশ্বের মানুষের সঙ্গেই আত্মিক যগাযোগ স্থাপন করে রয়েছে। মানুষের আবেগ, অনুভব, প্রেম, বিরহ, রাগ, অনুরাগ এসব তো সাহিত্যেই পাওয়া যায়। বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি যেরকম জরুরী তেমনই সাহিত্যও মানুষের এই প্রচন্ড ঘোড়দৌড় মার্কা জীবনের প্রমোদ-মায়া। তাই সাহিত্য করা হুজুগ তো নয়ই বরং বলা যেতে পারে একধরনের চাহিদা, যা মানুষকে তার অন্তরের সাথে, তার প্রত্যেকটি অনুভবের সাথে এক তরঙ্গে বেঁধে দিতে পারে। আসলে হুজুগ কথাটি বর্তমানে খুব শোনা যাচ্ছে কিছু সাহিত্যের সাথে জড়িত মানুষের মুখেই, এবং এটা কিছু ব্যাক্তির নিজস্ব ধারনা, সর্বসাধারণের অভিমত নয়। আর আমার মনে হয়না কেউ সামাজিক পরিচিতি লাভের জন্য সাহিত্য চর্চা করেন। এটা এক ধরনের অন্তঃস্রোত। যিনি সৃষ্টিশীল তাঁর কলম যেকোনো পরিস্থিতেই সৃষ্টি করবে তার মানস সন্তান, এবং কে তাঁকে চিনলো বা কে চিনলো না সে বিষয়ে উদাসীনতাতেই তিনি এক সার্থক রচনাকার। এক মগ্ন পথিক।



কবিতাউৎসব:  কাব্যচর্চা বলতে আপনি কি শিল্পসাহিত্যের জন্যেই কাব্যচর্চায় বিশ্বাসী? না কি মনে করেন কবিতারও একটা সামাজিক দায়বদ্ধতাও আছে? আপনার নিজস্ব সাহিত্যচর্চার জীবনের প্রেক্ষিতে যদি বিষয়টি একটু আলোচনা করেন। সামাজিক দায়বদ্ধতার নিরিখে,একজন সাহিত্যিকের সমাজসচেতনতা কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার?

চয়ন ভৌমিক: শুধুমাত্র শিল্প সাহিত্যের জন্য কাব্যচর্চা যেখানে সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই সেই রকম সাহিত্যচর্চায় বিশ্বাসী নই আমি। সে ক্ষেত্রে গল্প উপন্যাসের মত কবিতারও একটা দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করা যায় না। সামাজিক দায়বদ্ধতা কথাটার ব্যাপ্তি মাপা খুব কঠিন। তবুও আমাদের পারিপার্শ্বিক সামাজিক অবনমন গুলোর বিরূদ্ধেই আমাদের প্রতিবাদের ভাষা গর্জায়এবং এসমস্তটাই সময় ভিত্তিক। আমার মনে আছে, অভিজিত রায় বাংলাদেশে যখন মৌলবাদীদের হাতে নিহত হলেন আমাদের ভিতরটা নড়ে গিয়েছিল, কিংবা নির্ভয়া কান্ড, কামদুনি, বরুন হত্যা এসমস্তই আমাদের বারবার নাড়া দিয়েছিল। সবার মতই তখন আমার লেখাতেও এর ছাপ অবশ্যই ছিল। আসলে একজন সাহিত্যিক তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে এত সহজে নিঃশব্দে মানুষের কাছে যেতে পারেন, ততটা বোধহয় আর কেউই পারেন না, তাই সাহিত্যিকদের মধ্যে সমাজ সচেতনতা যতটা বাড়বে, তততাই সমাজের মঙ্গল।



কবিতাউৎসব:  এখন এই সমাজসচেতনতার প্রসঙ্গে একজন সাহিত্যিকের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আবার এই প্রসঙ্গে এইকথাও মনে হয় না কি, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যভুবনকে বৈচিত্রহীন করে তুলতে পারে? এমনকি হারিয়ে যেতে পারে সাহিত্যিক উৎকর্ষতাও?

চয়ন ভৌমিক: আমি মনে করি আমাদের দেশের নাগরিকরা প্রত্যেকেই দেশকে ভালোবাসেন। সাহিত্যিকরাও তার বাইরে নন। তাই দেশপ্রেমটা প্রবলেম নয়। তাহলে বাকী থাকে রাজনৈতিক মতাদর্শ, এবং সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। দলদাস কথাটি এখানে খুব মূল্যবান, এবং যে যত কম দলদাস তিনি বা সে তত প্রভাবমুক্ত লেখা লিখতে পারবেন তাঁর সামাজিক দায় অনুযায়ী। এবং এবার যদি পিছন থেকে দেখেন, যদি লেখক তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ রাখতে গিয়ে, তাঁর নিরপেক্ষ বিচার এড়িয়ে যান, সেটা ঘুরিয়ে দেশের প্রতি এবং তাঁর কাব্যপ্রতিভার প্রতিও একটা ঋণাত্মক বার্তা দেয়। যা অবশ্যই কালে দিনে তাঁর সাহিত্য উৎকর্ষতাকে নষ্ট করতে পারে। যদিও সেরকম উদাহরণ হাতে গোনা।



কবিতাউৎসব:  আবার এই সমাজসচেতনতার ভিত্তি সুদৃঢ় ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে কতটা জরুরী বলে মনে করেন আপনি,এবং কেন? কবি জীবনানন্দ যেমন জোর দিয়েছিলেন সুস্পষ্ট কালচেতনার উপর।

চয়ন ভৌমিক: কবিতা বা সাহিত্য কোনো বিশেষ বোধ কী মানে? সচেতনভাবে সৃষ্টি করতে গেলে সাহিত্য স্যাক্রিফাইজ্‌ড হয়ে যায়। ইতিহাস বোধ অবশ্যই থাকতে পারে কিন্তু তারও ওপরে যেটা জরুরী সেটা আমাদের সমাজকে জানা। সময়ের গতি প্রকৃতি জানা, এবং অবশ্যই একটা ভিশনকে দেখতে চাওয়া, যা আজ এবং আগামীকাল দুদিনই স্বতঃসিদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকবে – ঠিক সুকুমার রায়ের ছড়ার মত। আসলে আমরা কালের ব্যাপ্তি জানিনা। তাই কালচেতনা এই ব্যাপারটিও বেশ অবাস্তব। যেভাবে পৃথিবী পরিবর্তিত হচ্ছে কাল এবং চেতনা দুটোই প্রচন্ড অস্থিতিশীল হয়ে যাচ্ছে, এই অবস্থায় শুধু মুহূর্ত ধরেই রচনা করা আমার মতে সঠিক সিদ্ধান্ত।



কবিতাউৎসব:  এই যে স্বদেশপ্রেম,নিজের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতি দায়বদ্ধতা- এগুলি একজন সাহিত্যিককে আন্তর্জাতিকতার প্রেক্ষিতে কতটা সীমাবদ্ধ করে তোলে বলে মনে করেন আপনি? অর্থাৎ আপনার সাহিত্য তো প্রাথমিক ভাবে এই বাংলার সুর তাল লয়ের মন্থনই। কিন্তু সেই সাহিত্যের পরিমণ্ডলেও কি একজন বিদেশী তৃপ্তি পেতে পারেন যদি না আপনার লেখা আপনার স্বদেশপ্রেম আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উর্ধে উঠতে পারে? বিষয়টিকে আরও একটু অন্যরকম করে মেলে ধরলে বলা যায়, কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছাতে গেলে যে বিশ্ববোধ জরুরী, দেশপ্রেম স্বাজাত্যপ্রীতি কি সেই পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না?

চয়ন ভৌমিক: সাহিত্য কোনো সীমানা মানে না। সেখানকার মাটি এক। তাই লেখাও দেশ-কালের গন্ডী উত্তীর্ণ। লেখার বিষয়ের সাথে বিদেশী পাঠক একাত্ম হলেই তা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য অবশ্যই হবেওমর খৈয়াম, র‍্যাবো, নিকোলাস গিয়েনের কবিতা আমাদের আত্মস্থ করতে তো অসুবিধা হয়নি।



কবিতাউৎসব: সাম্প্রতিক অন্তর্জাল বিপ্লবে বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভুবন কি বিপুল পরিমাণে বিস্তৃত হয়ে গিয়েছে সেটা আমাদের সকলের চোখের সামনেই ঘটেছে ও ঘটছে। আগে লিটল ম্যাগাজিনের পরিসরের বাইরে অনেকটাই ফাঁকা জায়গা পড়ে থাকতো, যেখানে অনেকেই কবিতা লিখলেও তা চার দেওয়ালের বাইরে আলো দেখতে পেত না। আজ কিন্তু যে কেউই তার কবিতটিকে বিশ্বের দরবারে হাজির করতে পারছে। এই বিষয়টাকে আপনি ঠিক কি ভাবে দেখেন? অনেকেই যদিও বলছেন, এতে কবিতার জাত গিয়েছে চলে। এত বিপুল পরিমাণে অকবিতার স্তুপ জমে উঠছে, যে তার তলায় চাপা পরে যাচ্ছে প্রকৃত কবিতা। এই প্রবণতা বাংলা সাহিত্যের পক্ষে আদৌ কি আশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন আপনি? না কি এটি আসলেই অশনি সংকেত?

চয়ন ভৌমিক: অন্তর্জাল বা ইন্টারনেটের মাধ্যমের স্যোসাল মিডিয়ার প্রবেশ একটা বিশাল বিতর্কের জায়গা। তবুও আমি বলবো এতে কিন্তু মানুষকে সাহিত্যমুখী করেছে। লিটল ম্যাগাজিন যতটা না পৌঁছতে পেরেছিল মানুষের মুঠোয় তার থেকে অনেকগুন বেশী সাহিত্য এখন আমাদের মুঠোয়। এবং সেখানে ভালো মন্দ সবরকম লেখাই আছে। বেছে পড়ে নিলেই হল, গেল গেল রব তোলার কি হল এমন।



কবিতাউৎসব: সমাজজীবনে অস্থিরতা সাহিত্যচর্চার পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন? না কি যে কোন সামাজিক পরিস্থিতিই একজন প্রকৃত সাহিত্যিকের কাছে তার লেখার কার্যকারি উপাদান হয়ে উঠতে পারে। যেমন ধরা যাক ওপার বাংলায় বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, এপারের সত্তরের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের দশক; বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলার সাহিত্যচর্চার ভুবনটাকে তো বাড়িয়েই দিয়ে গিয়েছে বলা যেতে পারে। তাহলে সাম্প্রতিক মৌলবাদের উত্থান লেখক বুদ্ধিজীবী ধরে ধরে হত্যা,  রাজনীতি ও মৌলবাদের পারস্পরিক আঁতাত; নিরন্তর ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকার বাসনায় বুদ্ধিজীবীদের ক্রমাগত ভোলবদল- এই বিষয়গুলি অতি সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চার পরিসরকে নতুন দিগন্তে পৌঁছিয়ে দিতে পারে কি? বা পারলে সেটা কি বর্তমানে আদৌ হচ্ছে বলে মনে করনে আপনি?

চয়ন ভৌমিক: একজন কবি বা লেখকের অন্তরের দহন তাঁকে স্রষ্টা বানায়। সেখানে পরিবার পরিজন, সামাজিকতা, অভাব, অভিযোগ, স্বার্থরক্ষার্থে বুদ্ধিজীবিদের মতাদর্শ বদল, সামলেও কোনো এক ভিতরের দংশন তার হাত দিয়ে বার করে নিয়ে আসে বারুদ। আপনি সে উদাহরণ গুলো দিলেন উপরে এসব তারই ফল। এবং এটাই কালজয়ী। যতদিন এই কামড় থাকবে ততদিন রাজনীতির উর্দ্ধে উঠে সাহিত্যিকরা লিখবেন। এবং তা আজও হচ্ছে কালও হবে, অবশ্য ব্যাতিক্রমও আছে যেমন থাকে আরকি।



কবিতাউৎসব: আবার ধরা যাক এই সব নানান জটিলতা থেকে মুক্তি পেতেই একজন সাহিত্যিক বিশুদ্ধ কবিতার কাছে আশ্রয় পেতে ছুটলেন। যেখানে রাজনীতি নেই, সামাজিক অস্থিরতার দহন নেই, আছে শুধু ছন্দসুরের অনুপম যুগলবন্দী। জীবনের জটিল প্রশ্নগুলি এড়িয়ে গিয়ে,  কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে ছোটালেন তাঁর বিশ্বস্ত কলম। কবিতা তো মূলত কল্পনারই ভাষিক উদ্ভাসন। কিন্তু সেই পলায়নবাদী কবির কাছে পাঠকের আশ্রয় কি জুটবে? কবির কলম পাঠকের কাছে কতটা বিশ্বস্ত থাকবে সেক্ষেত্রে বলে মনে করেন?

চয়ন ভৌমিক: আসলে কবিতো পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী লেখেননা। তাঁরা তাদের মতো লেখেন এবং পাঠক তাঁর ভালোলাগা অনুযায়ী পড়েন। জীবনের যে সকল বিষয়, কবি তাঁর বিশেষ দর্শন দিয়ে ধরেন তাই কবিতা হয়ে যায়। সে আপনি জীবনের জটিল প্রশ্নই বলুন বা সহজ ছায়া সুন্দর নরম ছন্দের কবিতায় বলুন। কবিতা কবি নিজের বিশ্বাসে লেখেন আর পাঠক তার নিজস্ব বিশ্বাসে তা পড়েন। পাঠকের কাছে কবিতা ধরা দেয় তার জীবনের বিবিধ অনুভূতির আশ্রয়স্থল হিসাবে। আর তাই মননশীল পাঠক সমস্ত আবেদনের কবিতায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তার নিজস্ব সময় মতো, তার নিজস্ব চাহিদামতো, তাই পাঠকের কাছে কোনো কবিই পলায়নবাদী নন।



কবিতাউৎসব:  সাহিত্যে শ্লীলতা ও অশ্লীলতার তর্ক বহুদিনের। আজও সে বিতর্কের অবসান হয় নি বলা যায়। নিজের লেখা সম্পর্কে অনেক সাহিত্যিককেই অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হতে হয়েছে তার সময়ে বিভিন্ন সমালোচকের কাছে। আপনার সাহিত্যচর্চার জীবনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে এই বিষয়ে আপনার অভিমতে যদি সমৃদ্ধ করেন কবিতাউৎসবের পাঠকবৃন্দকে।

চয়ন ভৌমিক: ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, যে ভাষায় লিখলে আমার মা, মেয়ে, বউ আত্মীয় পরিজন প্রতিবেশী সবাই আমার কবিতা পড়তে পারেন বা অন্য মানুষদের পড়ে শোনাতে পারেন, সেই ভাষাতেই সাহিত্য করা উচিত সাধারণ ভাবে। ঘটনার প্রেক্ষিতে বা কোনো কোনো সময় সাহিত্যে এমন কিছু শব্দ বা বিষয়ের উল্লেখ করতেই হয় যদিও, যা নিয়ে বলার কিছুই নেই, এবং দেশী বা বিদেশী সাহিত্যে সে সমস্ত লেখা অসমাদৃত হয়েছে বলেও শোনা যায়নি। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে অশ্লীল শব্দের বহুল ব্যবহার, যা অবান্তর, এমন ভাষার ব্যবহার, যেসব সাধারণত ব্যবহারিক জীবনে আমরা উচ্চারণ করিনা, তা আমার নিজস্ব পছন্দের তালিকায় পড়েনা।



কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখণ্ডিত বাংলায় কলকাতা কেন্দ্রিক ও ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার দুটি ভিন্ন স্রোতের মধ্যে কি ভাবে সামঞ্জস্য বিধান করবেন বাংলাসাহিত্যের একজন পাঠক? ৪৭এর দেশভাগ বাংলাসাহিত্যের দিগন্তকে কতটা প্রসারিত করেছে বলে আপনার ধারণা। এই যে কাঁটাতারের দুইপারে ধুটি ভিন্ন ঘরানার বাংলাসাহিত্যের দিগন্ত দাঁড়িয়ে গেল; এইটি আপনি কি ভাবে দেখতে চান?

চয়ন ভৌমিক: সাহিত্যর ধারা ক্রমবিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। এবং দেশভাগের পর জাতিসত্ত্বা দ্বিখিন্ডিত হলেও দুই বাংলার সাহিত্যিকদের মধ্যে যোগাযোগ এবং সাহিত্যের আদানপ্রদান কখনোই বন্ধ হয়নি, ফলে দুদেশের সাহিত্য একে অপরের গায়ে গা লাগিয়েই চলেছেদেশভাগের পর ভারতবর্ষ যেমন ক্রমাগত আধুনিক কবিতা এবং পরীক্ষা নিরিক্ষার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে, বাংলাদেশও চেষ্টা করেছে নিজস্ব ধারায় সাহিত্য চর্চা করতে, কিন্তু আধুনিকতা দু জায়গাতেই এসেছে। এপ্রসঙ্গে বরঞ্চ বাংলাদেশকে একটু এগিয়েই রাখবো, মাতৃভাষা নিয়ে তাদের লড়াই, এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহিত্য তো এক প্রধান যুদ্ধের হাতিয়ার ছিল। বাংলাভাষা ইউ এন ও স্বীকৃত ভাষা আজ। একুশে ফেব্রুয়ারি যে আন্তর্জার্তিক ভাষা দিবস তার আন্দোলনের সূত্রপাতও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ বইমেলা ঘুরে এসে, এবং তাদের সাহিত্যিকদের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে এটুকু বলতে পারি, বাংলাসাহিত্যে দুদেশের মধ্যে কোনো কাঁটাতার নেই।



কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখণ্ডিত জাতিসত্ত্বায় সাম্প্রদায়িকতার যে চোরাস্রোত নিরন্তর বহমান,যাকে পুঁজি করে ইঙ্গমার্কীণ মহাশক্তি ও তাদের বঙ্গজ সহসাথীরা ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনীতিতে সদাসক্রিয় থাকে; নেট বিপ্লবের দৌলতে সুদূর ভবিষ্যতে সেই সাম্প্রদায়িকতার চোরাস্রোত থেকে কি গোটা জাতিকে মুক্ত করতে পারবো আমরা? আপনার অভিমত! আর সেই কাজে সাহিত্যের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে আপনি মনে করেন!

চয়ন ভৌমিক: আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, সাহিত্য এই সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের প্রতিবাদ অবশ্যই করতে পারে। লেখালিখির মাধ্যমে জনজাগরণের একটা প্রচেষ্টা তো অবশ্যই করতে হবে, এবং হচ্ছেও। যদিও তার ফলে আমরা অভিজিতের মত মুক্তমনাদের হারাচ্ছি। সেকারণেই, এর থেকে গোটা জাতিকে মুক্ত করতে এগিয়ে আসতে হবে সমস্ত শ্রেণির মানুষকে, এবং অবশ্যই প্রশাসন ও রাজনীতিকদের। সর্বস্তরের লড়াই দরকার আর সেখানেই সর্ষের মধ্যে ভূত আছে বলে আমার অন্তত মনে হয়।



কবিতাউৎসব: এবার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অভিমুখে এসে আপনার নিজের লেখালেখির বিষয়ে যদি জানতে চাই, আপনার পাঠকের কাছে ঠিক কি ভাবে পৌঁছাতে প্রয়াসী আপনি?

চয়ন ভৌমিক: আমি খুবই অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্ব বলতে পারেন। আমার রাগ, দুঃখ, অভিমান, ভালোবাসা, প্রতিবাদ, শ্লেষ প্রকাশ করার ভাষা কবিতা। লিখি ছোটোবেলা থেকেই কিন্তু কখনোই চিন্তা করিনি আমার লেখা পাঠকের পড়ার উপযুক্ত। অল্প বয়সে জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে চেষ্টাও করিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠাতে। পরে ফেসবুকে লিখতে থাকি, এবং সেখানে অনেকেই আমাকে উৎসাহ প্রদান করেন আরো লিখতে। হয়তো তাদেরই উৎসাহে দেশ, কৃত্তিবাস, লংজার্নি এবং বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে আমার লেখা বেরিয়েছে। সম্পাদকেরা যে আমার পাঠানো লেখাগুলি ছেপেছেন এতে যারপরনাই কৃতজ্ঞ আমি ওনাদের কাছে। এবং এভাবেই সামান্য হলেও কিছু পাঠকের কাছে পৌঁছেছে আমার লেখা।



কবিতাউৎসব: ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে আপনার মনে কি স্পষ্ট কোন ছায়পাত পড়ে?

চয়ন ভৌমিক: বাংলা সাহিত্য চর্চা যে কমে যাচ্ছে এবিষয়ে নিঃসন্দেহ আমি। বাংলাদেশে কিন্তু এমন নয়। সেখানকার মানুষ আবেগ দিয়ে সাহিত্য চর্চা করেন। এখানকার তরুণ তরুণীদের থেকে অনেকাংশ বেশী বাংলাচর্চা ওখানে। এখনকার বাসে ট্রামে যে ধরনের মিশ্রভাষার কথা শুনতে পাওয়া যায়, তা আমাকে ভাবায় এবং খুব চিন্তা হয় অদূর ভবিষ্যতে আমাদের মাতৃভাষা এবং মাতৃভাষার সাহিত্যচর্চা হারিয়ে না যায়।