শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০

সম্পাদকের কলমে





এই সময়ের কবিতা

এই সময়ের বড়ো বৈশিষ্টি, প্রায় সকলেই কবিতা লিখছেন। তার একমাত্র কারণ ইনটারনেট ও সেশ্যাল মিডিয়া। কেন বলছি সকলেই কবিতা লিখছেন, বলছি এই কারণে নয় যে এর আগে সকলেই কবিতা লিখতেন না, বিষয়টা ঠিক তাও নয়। আগেও অনেকেই কবিতা লিখতেন। কিন্তু তার পাঠক শুধু তিনি নিজেই ছিলেন। কবিতা লেখার খামতি যে ছিল তা নয়। কিন্তু তা চানঘরে গানের মতোই একান্ত নিজস্ব একটি বিষয় ছিল। কিন্তু এই ইনটারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ সেই চানঘরের গায়কদেরকেও একটা মঞ্চ জুগিয়ে দিল। আর সেই কারণেই আজ সকলেই কবি। নিজের লেখা আর নিজের কাছে আটকিয়ে রাখতে হল না। তা ছড়িয়ে দেওয়া গেল বিশ্বময়। অর্থাৎ প্রকাশিত হলো অবরুদ্ধ সঙ্গীত। অনেকটাই ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত হয়ে ছিল যা, তা আজ প্রকাশের মহীমায় গরীয়ান হয়ে উঠেছে বন্ধুবৃত্তের বদান্যতায়। তাই সকলেই আজ কবিতা লিখছেন আরও বেশি করে। আগে যা ছিল কদাচিৎ ঘটনা, এখন সেটাই যেন হয়ে দাঁড়ালো রোজকার রেওয়াজ। নিজের ওয়াল। নিজের কবিতা। তাই যত লিখি ততই কবিতা।

কিন্তু শুধুমাত্র সোশ্যালমিডিয়ার কবি নিয়েই তো আর বাংলাসাহিত্যের কাব্যজগত নয়। কোনকালেই তা ছিল না। আজও নেই। সাহিত্যসমাজের প্রতিষ্ঠিত কবিরা ঠিক কি করছেন আজকাল। কেন, অবশ্যই তাঁরাও কবিতা লিখছেন। কিন্তু শুধুই কি কবিতা লিখছেন। না, নিশ্চয় তাও নয়। যে যার প্রয়োজন ও রুচি মতো ঢাকও বাজাচ্ছেন বইকি। ঢাকও বাজাচ্ছেন মানে? মানে এই একুশ শতকটাই এমনই। সবাই এখানে এক একজন সেলস-ম্যান। গোটা পৃথিবীটাই একটা বৃহৎ মার্কেট। এই মার্কেটে টিকে থাকতে গেলে ও উন্নতি করতে গেলে, বেচতে হবে। শুধু বেচলেই হবে না আবার। এমন ভাবেই বেচতে হবে যাতে লাভের গুড় পিঁপড়েয় না খেয়ে যায়, বরং বাড়িয়ে নিতে হবে মুনাফার পরিমাণ যতটা সম্ভব। কিন্তু কবিতা? হ্যাঁ কবিতাও বেচতে হবে বইকি। শুধু কবিতা বেচলেও আবার হবে না। বেচতে হবে কবি প্রসিদ্ধিও। যে যত ভালো বেচতে পারবেন, তিনিই তত বড় কবি আজ। হ্যাঁ এটাই একুশ শতক।

না আজ আর তাই নিজের ঢাক নিজে পেটানোয় কোন লজ্জা নাই। বরং যিনি ঠিকঠাকমত সেই ঢাকে কাঠির বাড়ি মারতে পারবেন না সময়ের তালে তালে, তিনিই কবি সমাজে ব্রাত্য। পৌঁছাবে না পাঠকের কাছে তাঁর কবিতা। এখন কিভাবে বেচবেন আপনি আপনার কবিতার ভুবন? না আপনাকে বুঝে নিতে হবে হওয়া এখন কোনদিকে। হওয়ার উল্টোস্রোতে দাঁড় টানতে গেলে, হয়ে গেল। সম্পূর্ণ একা পড়ে যেতে হবে। বসে থাকতে হবে নিজেকে নিয়ে নিজের সাথেই। তাই হওয়ার বাঁক বুঝে যিনি যত দ্রুত গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে পারবেন, হ্যাঁ তিনিই আজকের মানদণ্ডে তত বড়ো সেলস-ম্যান। আর ভালো সেলস্-ম্যান হলে তবেই আপনি হতে পারবেন সকলের প্রিয় কবি। এবং এই যে সকলের প্রিয় হয়ে ওঠা, এইটি কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজকের কবিসমাজে। এটা অনেকটাই গণতন্ত্রের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মতোই। কেউ যদি মাত্র তিরিশ শতাংশ ভোট পেয়েও সবচেয়ে বেশি আসন জিতে নেয়, তবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তিনিই বিজয়ী। অর্থাৎ কবি সমাজেও ঠিক তেমনই আপনার ঢাকের বাদ্যি যদি বেশি লোকের কানে পৌঁছিয়ে যায়, তবে আপনিই সকলের প্রিয় কবি। অর্থাৎ প্রচারের মহিমায় সবসময় আপনাকে এগিয়ে থাকতে হবে সকলের থেকে। যার প্রচার যত বেশি, সেই তত জনপ্রিয়। আর জনপ্রিয়তাই আজকের যুগে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। তাই জনপ্রিয় না হতে পারলে, আপনার কবিতা লেখাই মাটি।

আর ঠিক এইখানেই আজকের কবিতার নোঙর। কবিতা এখন জনপ্রিয়তার দৌড়ে সামিল হয়ে গিয়েছে। এমন কবিতা লিখতে হবে, এমন ভাবেই লিখতে হবে যে বহু লোকের মনোরঞ্জন করা যায়। অর্থাৎ কবিতার ভিতরেও থকতে হবে বিনোদেনের চাবিকাঠি। কারণ বিনোদন ছাড়া মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা সম্ভব নয়। আর বিনোদন সেটাই, মানুষ যাতে বেশি করে আমোদ লাভ করে। ফলে কবিকেও আমোদ দিতে হবে। কবিতাকেও হতে হবে আমোদের সামগ্রী। আর তারপর আপনার সেলস্-ম্যানশিপের হাতযশ। সবকিছু ঠিকঠাক চললে কেল্লাফতে। আর তখনই বিভিন্ন ধরণের শক্তির ভরকেন্দ্র আপনাকে টানতে থাকবে নিজেদের দিকে। অনেকটা পুরাকালের সভাকবির মতো আপনিও গুছিয়ে নিতে পারবেন ভাবি চৌদ্দপুরুষের ভবিষ্যৎ।

একুশের শতকের বাংলা কবিতার যুগলক্ষণগুলি অনুধাবন করলেই সুস্পষ্ট হবে এই সারসত্য। কবিতা এখন এস্টাব্লিশমেন্টের সাথে হাতধরাধরি করে চলে। সে কখনোই এস্টাব্লিশমেন্টকে আর প্রশ্ন করে। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় না। সামনাসামনি হয়ে বিতর্কে অবতীর্ণ হয় না। বরং সভাকবির মতোই এস্টাব্লিশমেন্টের বন্দনাগীত রচনা করে জাতে ওঠার চেষ্টা করে নিরন্তর। এটাই এসময়ের কবিতার প্রধান যুগলক্ষণ। তিনিই আজকে তত বড়ো কবি যিনি একাধারে এষ্টাব্লিশমেন্টের নেক নজরে থেকে জনগণকে যত বেশি আমোদ দিতে পারবেন। হ্যাঁ অবশ্যই এষ্টাব্লিশমেন্ট সবসময়েই বিভিন্ন শিবিরে বিভক্ত থাকতেই পারে। ঠিক যেমন মার্কীণ রাজনীতিতে ডেমোক্রেট আর রিপাবলিকান। এখন আপনি কখন কোন শিবিরের শরণাপন্ন হবেন সেটা আপনার প্রজ্ঞা। সবসময়েই যে এক শিবিরের হয়েই ওকালতি করে যেতে হবে, না তেমনটাও নয়। বরং সময়ের পদধ্বনিতে কান পেতে যিনি যত দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, তিনিই তত মহৎ কবি।

তাই আজকের বাংলা কবিতায় এই সময়ের যুগলক্ষণগুলি অত্যন্ত সুস্পষ্ট। যুগযন্ত্রণার প্রতিধ্বনী নয়, যুগলক্ষণের প্রতিফলনই আজকের বাংলা কবিতা। সে প্রশ্ন করতে অপারগ। সে উত্তর খুঁজতে ভুলে গিয়েছে। সে আর অনুসন্ধান করে না। সে মুখোমুখি হয় না মুখ আয়নার। সে নিজের সমস্ত অসঙ্গতিকে ঢেকে রাখে চড়া মেকআপে। বর্তমানের অসুখগুলিকে সে দেখতে পায় না। কারণ সে ক্ষমতার প্রসাদ পেয়ে চোখ বুঁজে ফেলেছে। বাংলার মাটির স্পন্দনও আজ আর কোন অনুরণন তোলে না তার কানে। কারণ সেখানে সর্বদাই আত্মপ্রচারের ঢক্কানিনাদ। তাই সমাজটাকে সে দেখে, ঠিক সেই ভাবেই, যেভাবে দেখলে এষ্টাব্লিশমেন্টের নেকনজরে থাকা যায় পরম নিশ্চিন্তে। এই যে পরম নিশ্চিন্তি, এটাই এইসময়ের কবিতার অন্যতম যুগলক্ষণও বটে। কবিমাত্রেই আজ এই পরম নিশ্চিন্তির খোঁজে। তাই বিরূপ সমালোচনাও আজ আর সহ্য করার মানসিকতা দেখা যায় না কবিসমাজে। আত্মসমীক্ষার অবলুপ্ত দিগন্তে আজ সবাই রাজা। এই পরম নিশ্চিন্তির যুগে আটকা পড়ে আজ বাংলা কবিতার ভুবন। কখন যে সে এষ্টাব্লিশমেন্টের এক্সটেনশন হয়ে উঠেছে, সে সত্য সম্বন্ধেও সে আর সচেতন নয়।

এমনই এক অচেতন সময়ের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে বাংলা কবিতার ভুবন। এই যে এগিয়ে চলা, এই চলার নাই কোন নির্দিষ্ট অভিমুখ বা গন্তব্য। শুধু সময়ের ফুরিয়ে যাওয়ার সাপেক্ষে একই অক্ষের চারপাশে ক্রমাগত ঘুরপাক খাওয়া। আর সেই ঘূর্ণনেই কবি প্রসিদ্ধির সুউচ্চ প্রাসাদে অধিষ্ঠিত আজকের বিশিষ্ট কবিবৃন্দ।